ফাইল চিত্র।
২০১৭ সালের ১৩ জানুয়ারি। পটনা থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে আওরঙ্গাবাদের একটি তাপবিদ্যুৎ শক্তি কেন্দ্রে হঠাৎ পর পর গুলির শব্দ। মুহূর্তে খবর ছড়িয়ে পড়ে, ওই কেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ‘সেন্ট্রাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স’-এর (সিআইএসএফ) এক কনস্টেবল ডিউটি বদলের ‘রোল কল’ চলাকালীন হঠাৎ বন্দুক থেকে গুলি ছুড়তে শুরু করেছেন। দু’জন ঘটনাস্থলেই মারা যান। পরে আরও দু’জনের মৃত্যু হয় হাসপাতালে। তদন্তে উঠে আসে, দিনের পর দিন ছুটি চেয়েও না পাওয়ার রাগে এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন ওই কনস্টেবল।
ওই ঘটনার সঙ্গে অনেকেই মিল খুঁজছেন শনিবারের কলকাতার জাদুঘরে গুলি-কাণ্ডের। এ ক্ষেত্রেও গুলি চালানো হয়েছে সন্ধ্যায় ডিউটি বদলের রোল কলের সময়ে। এ ক্ষেত্রেও ছুটি চেয়ে না পাওয়ার এবং অবসাদের তত্ত্ব উঠে আসছে। সিআইএসএফ সূত্রে প্রাথমিক ভাবে জানা যাচ্ছে, গুলি চালান যে সিআইএসএফ কনস্টেবল, তাঁর বাবার মৃত্যু হয় এপ্রিলের শেষে। সেই জন্য ছুটি নিয়ে তিনি ওড়িশায় গ্রামের বাড়িতে যান। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এসে কাজে যোগ দিতে পারেননি। ওড়িশায় থাকাকালীন তাঁর আরও এক আত্মীয়ের মৃত্যু হয়। ফলে সেখানে ১ মাস থেকে যেতে হয় তাঁকে। কেন সময়ে কাজে যোগ দেননি, এ নিয়ে তাঁর কর্মস্থলে সমস্যা তৈরি হয়েছিল। আরও কয়েক দিন গ্রামে কাটিয়ে আসতে চাইলেও তাঁকে সেই সময় দেওয়া হয়নি বলে সূত্রের খবর।
কেন্দ্রীয় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীতে ছুটি না পাওয়া নিয়ে এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। আত্মহত্যা বা সহকর্মীদের উপরে গুলি চালানোর এমন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এক সময় নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের খবর, গত ন’বছরে কেন্দ্রীয় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীতে কর্তব্যরত অবস্থায় আত্মঘাতী হয়েছেন ১২০০ জনেরও বেশি। এর মধ্যে সিআইএসএফ, সিআরপিএফ এবং বিএসএফ-এ মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। লোকসভায় জমা পড়া রিপোর্ট বলছে, ২০২১ সালেই এমন ঘটনায় ১৫৬ জন আত্মঘাতী হয়েছেন, যা গত এক দশকে সর্বোচ্চ। লকডাউন থেকেই যা ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। ২০২০ সালেও এমন মৃত্যুর সংখ্যা ১৪৩। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ২০২১-এর অক্টোবরে টাস্ক ফোর্স গঠন করে সরকার। কী কী কারণে এমন ঘটনা ঘটে চলেছে, তা বার করার দায়িত্ব দেওয়া হয় টাস্ক ফোর্সের উপরে।
জানা যায়, এমন সশস্ত্র বাহিনীতে অবসাদের অন্যতম কারণ দিনের পর দিন ছুটি না পাওয়া। পেলেও সেই ছুটি বাতিল হওয়া। কাজে যোগ দেওয়ার পরে সে ভাবে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে না পারা। এই পরিপ্রেক্ষিতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাহিনীতে এক বছরে ছুটি ৭৫ দিন থেকে বাড়িয়ে ১০০ দিন করা যায় কি না, তা দেখা হচ্ছে বলে ঘোষণা করেন। ক্যাজ়ুয়াল লিভ ১৫ দিন থেকে বাড়িয়ে ৩০ দিন করে এবং অন্য আরও কিছু ছুটি যোগ করে এই পথে হাঁটার চেষ্টা হয়। সেই সঙ্গে যতটা সম্ভব বাড়ির কাছে নিয়োগ করার এবং পরিবারের সঙ্গে থাকার সুযোগ করে দেওয়ার চেষ্টাও হয়। সিআইএসএফ-এর এক কর্তা এ দিনে বলেন, ‘‘বছরে যে কেউ ১০০ দিন ছুটি নিতে পারেন এখন। ফলে এ নিয়ে সমস্যা থাকার কথা নয়।’’
কিন্তু কলকাতায় নিযুক্ত এক সিআইএসএফ অফিসার বললেন, ‘‘আদতে এই নিয়ম হয়েছে খাতায়-কলমে। বাস্তবে এক বছর আগে থেকে নিয়ে রাখা ছুটিও বাতিল হয়ে যায়।’’ অন্য এক কর্মীর মন্তব্য, ‘‘আমারই ছুটি গত তিন মাস ধরে বাতিল হচ্ছে। বাহিনীতে নাকি লোক নেই! শেষে বহু মাস পরে গ্রামে যেতে পারলেও তিন দিনের মধ্যে চলে আসতে বলা হয়। কারণ হিসাবে জানানো হয়, অন্য কর্মীরা অসুস্থ হয়েছেন। কয়েক মাস এ ভাবে চলে। কিন্তু বছরের পর বছর এ ভাবে চলে না।’’
মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘হাতে অস্ত্র নিয়ে কাজ করছেন যাঁরা, তাঁদের মন ভাল রাখার দিকটা আলাদা করে নজর দিতেই হবে। আর সব স্তরের কর্তাদের মনে রাখতে হবে, কাজের জন্য জীবন নয়, জীবনের জন্য কাজ।’’