‘ছেলেটা যে চলে গেল, সেটা কিছু নয়!’

বেহালার শীলপাড়ায় সৌমেনের মামার বাড়িতে বসেই কথা বলছিলেন অনিতা। ছোট থেকে মামার বাড়িতেই মানুষ বছর সাতাশের সৌমেন। কলেজ স্ট্রিট থেকে বই কিনে বন্ধুর সঙ্গে স্কুটারে চেপে ঠিক এক সপ্তাহ আগে অভিশপ্ত বিকেলে মামার বাড়িতেই ফিরছিলেন।

Advertisement

মেহবুব কাদের চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৩:৫২
Share:

মাঝেরহাট সেতু ভেঙে মৃত সৌমেন বাগের মা। ছবি: রণজিৎ নন্দী

ঘরের আলমারির তাক ভরা বাংলা-ইংরেজি সাহিত্যের বইয়ের ছড়াছড়ি। কিংবা নিছকই বই নয়, বইপোকা এক যুবকের তরতাজা আবেগের স্বাক্ষর!

Advertisement

মঙ্গলবার দুপুরে সেই বইয়ের দিকে তাকিয়েই পুত্রহারা মা বললেন, ‘‘শুনেছি মাঝেরহাট ব্রিজ ভাঙার পরে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘বড় দুর্ঘটনা হতে পারত!’ আমার ছেলেটা চলে গেল, সেটা কি কিছু নয়? শুধু মৃতের সংখ্যা দিয়ে কি এত বড় দুর্ঘটনা মাপা যায়?’’ মাঝেরহাট সেতুভঙ্গের ঘটনায় মৃত সৌমেন বাগের মা অনিতা তিনি। তাঁর দাবি, ‘‘কাগজে দেখেছি, ব্রিজটা তো পূর্ত দফতরেরই সামলানোর কথা! রাজ্য সরকার কেন এত বড় দুর্ঘটনার দায় এড়াচ্ছে? যাদের জন্য ব্রিজ ভাঙল, তাদের কঠোর শাস্তি চাই! আরও দুই মায়েরও তো কোল খালি হয়েছে। সাত দিন কাটলেও কেউ গ্রেফতার হল না!’’

বেহালার শীলপাড়ায় সৌমেনের মামার বাড়িতে বসেই কথা বলছিলেন অনিতা। ছোট থেকে মামার বাড়িতেই মানুষ বছর সাতাশের সৌমেন। কলেজ স্ট্রিট থেকে বই কিনে বন্ধুর সঙ্গে স্কুটারে চেপে ঠিক এক সপ্তাহ আগে অভিশপ্ত বিকেলে মামার বাড়িতেই ফিরছিলেন। সরকারি কর্তারা এসে পাঁচ লক্ষ টাকার চেক দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু মায়ের প্রশ্ন, ‘‘স্রেফ টাকা দিয়ে কি এই ক্ষতি মাপা যায়! একটা আস্ত উড়ালপুল খসে পড়বে, এটা কি সত্যি ভাবতে পারা যায়!’’

Advertisement

সৌমেনের বাবা প্রদীপ বাগ জোড়াসাঁকো এলাকায় ফলমান্ডির দোকানে সামান্য কর্মচারী। মা-বাবা পাতিপুকুরে থাকতেন। মামার বাড়িতে গত সোমবার সৌমেনের পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পু্ত্রহারা দম্পতি এখন সেই বাড়িতেই আছেন। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে অনিতাদেবী বললেন, ‘‘এত বড় দুর্ঘটনার পর শহরের অন্য সেতুগুলি নিয়েও নানা কথা শুনতে পাচ্ছি। আর কোনও মায়ের আমার মতো দশা যেন না হয়।’’

বাণিজ্যে স্নাতক সৌমেন কিছু দিন হল স্থানীয় একটি ওষুধের দোকানে হিসেব সামলানোর কাজ করছিলেন। অনিতা বললেন, ‘‘ছেলেটা দিন দিন বাড়ির সবার অভিভাবক হয়ে উঠছিল! হয়তো দরখাস্ত লিখতে হবে, সৌমেনই সবার ভরসা!’’

পাড়ার সকলেরই প্রিয় ছিলেন সৌমেন। দুর্ঘটনার দু’দিন পরে এক প্রতিবেশী মৃত যুবকের ছবি এঁকে বাঁধিয়ে দিয়েছেন। সেই ছবি হাতে অপলক তাকিয়ে ছিলেন সৌমেনের মা। ‘‘বাবা, তুই নেই। আমরা বাঁচব কাকে নিয়ে?’’ থম মেরে গিয়েছেন সৌমেনের বাবা। কোনও মতে বললেন, ‘‘আমাদের কী করে চলবে, মাথায় ঢুকছে না!’’ তাঁর আশা, সরকার কোনও কাজ দিলে তাও পরিবারটাকে টানার চেষ্টা করা যেত।

শহরের সেতু-ভাঙা ক্ষত অকালে ঝরে যাওয়া এক জীবনের অপচয়েরও নামান্তর হয়ে উঠেছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement