ধূমপান করার ‘অপরাধে’ নেতাজিনগরের তরুণীকে নিগ্রহের ঘটনায় মূল অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতেই ৪৮ ঘণ্টা লেগে গেল পুলিশের। অভিযোগ পাওয়ার আড়াই দিন পরে, প্রবল চাপের মুখে সোমবার সন্ধ্যায় নেতাজিনগর থানার পুলিশ কমল গঙ্গোপাধ্যায় নামে ৭০ বছরের ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে। যদিও শুক্রবার রাতের ওই ঘটনার পরের দিনই সংবাদপত্রে অভিযুক্তের নাম প্রকাশিত হয়েছিল। এলাকায় সক্রিয় তৃণমূল সমর্থক বলে পরিচিত ওই বৃদ্ধ ওই পাড়ারই বাসিন্দা। তাঁর পরিবারও ঘটনার কথা স্বীকার করে। আজ, মঙ্গলবার ধৃতকে আদালতে হাজির করানো হবে।
শেষমেশ তাঁকে গ্রেফতার করা হলেও প্রশ্ন উঠেছে, শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বলেই কি কমলবাবুকে ধরতে গড়িমসি করছিল পুলিশ? গ্রেফতার হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে, এ দিন পল্লিশ্রীর এক জায়গায় বসে কমলবাবু নিজেই আনন্দবাজারকে জানান, তিনি তৃণমূল সমর্থক। ঠিক তখনই পুলিশ তাঁর খোঁজে ওই জায়গা থেকে ৫০০ মিটার দূরে তাঁর বাড়ি গিয়ে ফিরে আসে। শুক্রবার রাতে তরুণীর অভিযোগ পাওয়া, তা নিয়ে হইচই শুরু হওয়া ইস্তক সেটাই কমলবাবুর বাড়িতে প্রথম ‘পুলিশি হানা’। টালিগঞ্জে তৃণমূলের এ বারের প্রার্থী, বিদায়ী বিধায়ক ও মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস নিজেও রবিবার আনন্দবাজারকে জানিয়েছিলেন, ওই তরুণীর সঙ্গে এক ব্যক্তি ও তাঁর ছেলের গণ্ডগোলের কথা তিনি জেনেছেন। মন্ত্রীর কথায় ইঙ্গিত ছিল, তিনি সেই ব্যক্তি অর্থাৎ কমল গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম জানেন।
খোদ পুলিশের একাংশও ঠারেঠোরে শাসক দলের ‘চাপ’-এর বিষয়টিই মেনে নিচ্ছেন। লালবাজারের এক কর্তার কথায়, ‘‘নেহাত এক তরুণীর অভিযোগ ও তার পরে বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে হইচই। সেই জন্যই পুলিশ শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থা নিল। না হলে ঘটনাটি ঘটেছে বলে অভিযুক্ত ও তাঁর বাড়ির লোকজন স্বীকার করে নেওয়ার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পরেও পুলিশ হাত গুটিয়ে বসে থাকল! অন্য সময়ে শাসকদলের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়ে পুলিশ বহু ক্ষেত্রে কী করে, সেটা এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে।’’
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ওই তরুণী শুক্রবার রাতে এক পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে পল্লিশ্রী এলাকা দিয়ে হেঁটে ফিরছিলেন। তাঁর অভিযোগ, তখন ‘একটি মেয়ে কেন সিগারেট খাবে,’ সেই প্রশ্ন তুলে এক দল লোক তাঁদের উপরে চড়াও হন। প্রতিবাদ করলে তাঁর বন্ধুকে মারধর এবং তাঁকে শারীরিক নিগ্রহ ও অশ্রাব্য গালিগালাজ করা হয় বলেও অভিযোগ জানান তরুণী।
কমলবাবু গ্রেফতার হওয়ার পরে এ দিন ওই পড়ুয়ার প্রতিক্রিয়া, ‘‘গ্রেফতার করতে পুলিশ এত দেরি করল কেন? আমি তো শুক্রবার রাতে অভিযোগ করেছি।’’ সংবাদমাধ্যমে ধৃতের ছবি দেখে ওই ছাত্রীর দাবি, ‘‘এই ব্যক্তিই আমার বন্ধুকে চড় মারেন। বাধা দিতে গেলে আমাকে ধাক্কা দেন, অকথ্য গালিগালাজ করেন।’’ ওই ছাত্রীর মনোবল যাতে না ভাঙে, সেই জন্য তাঁরা পাশে আছেন বলে এ দিন জানিয়েছেন প্রেসিডেন্সির শিক্ষক ও পড়ুয়াদের একাংশ।
অথচ শুক্রবার রাতে ওই তরুণী ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ কয়েক জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করার পর শনিবারই তদন্তকারীরা কমল গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁর ছেলে শৌভিকের নাম জানতে পারেন। ওই তল্লাট টালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে। তৃণমূলেরই একটি সূত্রের খবর, স্থানীয় বিধায়ক অরূপ বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠ এক নেতার অনুগত বলেই সব কিছু জেনেও কমলবাবুকে ছুঁতে পুলিশ ইতস্তত করছিল। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী কমলবাবু এখন বাড়ি কেনাবেচায় যুক্ত। স্থানীয়দের একাংশের বক্তব্য, তিনি আগে কংগ্রেস করতেন। পরে তৃণমূল সমর্থক হন। ২০১১ থেকে তাঁর ‘খবরদারি’ও বাড়ে।
সেই ব্যক্তির বাড়িতে শনি-রবিবার একবারও পুলিশ যায়নি, খোঁজ পায়নি। এমন নয় যে, তিনি ওই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র গিয়েছিলেন। রবিবার কমলবাবু একটি সূত্রে জানেন, ঘটনাটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। মোবাইল বন্ধ করে বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান, ফেরেন রাতে। ফের এ দিন সকালে বেরিয়ে যান।
রবিবার রাত পর্যন্ত পুলিশ দাবি করেছে, ‘‘ছাত্রীর কাছে অজ্ঞাতপরিচয় হামলাকারীদের খোঁজ চলছে।’’ তরুণীর বর্ণনা শুনে পোর্ট্রেট পার্লেও আঁকাতে উদ্যোগী হয় পুলিশ। সোমবার ছবি আঁকানো হয়। কিন্তু ঘটনা হল, ওই পোর্ট্রেট পার্লে হাতে আসার আগেই পুলিশ কমল গঙ্গোপাধ্যায়কে তাঁর বাড়ির সামনে থেকে গ্রেফতার করে।
এক পুলিশ আধিকারিকের কথায়, ‘‘এই সব ছবি-টবি আঁকিয়ে আসলে সময় নষ্ট করছিল পুলিশ। সদিচ্ছা থাকলে রবিবারই ওই ব্যক্তিকে ধরে আনা যেত। কমল গঙ্গোপাধ্যায় তো অন্য এলাকার বাসিন্দা নন! এমনও নয় যে, তিনি ঘটনার কথা অস্বীকার করছেন।’’
কিন্তু কমলবাবু ঘটনায় জড়িত বলে তাঁর পরিবারের স্বীকারোক্তি এ দিন সংবাদপত্রে প্রকাশের পরেই কার্যত বেকায়দায় পড়ে পুলিশ। তৃণমূলের কিছু নেতাকে পুলিশ ফোন করে বলে, ‘‘ওঁর বাড়ির লোকই তো সব বলে দিয়েছেন। এ বার কী করব?’’ কলকাতা পুরসভার ১০ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান, তৃণমূলের তপন দাশগুপ্তের দাবি, ‘‘তৃণমূল পুলিশ-প্রশাসনের কাজে হস্তক্ষেপ করে না।’’
কিন্তু এক জন তরুণী ধূমপান করলে হস্তক্ষেপ করার তিনি কে?
স্থানীয়দের একাংশের বক্তব্য, বিজয়গড়, নেতাজিনগর-সহ কলোনি এলাকায় বহু বাসিন্দাই এখনও যথেষ্ট সংরক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন। তাই তাঁদের চোখে ‘অশোভন’ কিছু ঠেকলে ছোটদের তিরস্কার করার রেওয়াজ এখানে রয়েছে। এর সঙ্গে সরাসরি রাজনীতির যোগ খুঁজলে বহু ক্ষেত্রে তা ভুল হবে। তবে এ ক্ষেত্রে ওই বৃদ্ধ শাসক দলের সমর্থক হওয়ায় তাঁর ভর্ৎসনার মাত্রা অবশ্যই বেড়েছে। সমস্যা সেখানেই।
গ্রেফতারের আগে কমলবাবুর দাবি, ‘‘সিগারেট খাওয়া নিয়ে কিছু বলিনি। মেয়েটি পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় অশালীন ভাবে দাঁড়িয়েছিল। তাই আপত্তি করি। কিন্তু ওরা বিচ্ছিরি ভাবে তর্ক জুড়ে দেয়।’’ কমলবাবুর দাবি, ‘‘মেয়েটির বন্ধুর গায়ে হাত তুলিনি। চেঁচামেচি শুনে কয়েক জন এসে ওদের সরিয়ে দেয়। তাঁদের কেউ ছেলেটিকে মেরেছিল কি না, জানি না।’’ যদিও এক জন পুরুষ ও মহিলা অশালীন আচরণ করছেন বলে মনে হলেও আইন অনুযায়ী তাঁর বাধা দেওয়ার অধিকার নেই। পুলিশে অভিযোগ জানানো যায়।
ওই তরুণী অবশ্য বলছেন, ‘‘আমরা দু’জন তো সিগারেট খেতে খেতে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। এতে অশালীন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকার প্রশ্নই বা আসছে কেন?’’