উল্টো দিকেই সেই বাড়ি। ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন রেণু প্রামাণিক। শনিবার। — নিজস্ব চিত্র
বসতি এলাকার একটি গেরস্ত বাড়িতে গানবাজনা-সাউন্ড বক্স সহযোগে চলছিল উদ্দাম পার্টি। রাত তখন ২টো। পাশের বাড়ির লোকজন তিষ্ঠোতে না পেরে অত রাতে উজিয়ে বারণ করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা শোনা তো দূরের কথা, পার্টিতে সামিল উন্মত্ত তরুণ-তরুণীরা প্রথমে তাঁদের হেনস্থা করেন এবং তার পরে পুলিশ পৌঁছলে তাঁদেরও নিগ্রহ করা হয় বলে অভিযোগ। এমনকী, এক সাব-ইনস্পেক্টরের উর্দিতে লাগানো নেমপ্লেট টেনে ছিঁড়ে দেওয়া হয়েছে।
শুক্রবার রাতে গোলপার্কের কাছে ওই ঘটনায় তিন তরুণী-সহ ১১ জনকে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকেই গ্রেফতার করে। শনিবার ধৃতদের আলিপুর আদালতে হাজির করানো হলে ১০ জন জামিনে মুক্তি পান। তবে সর্বজয়া চৌধুরী নামে ধৃত ২৯ বছরের এক তরুণীকে বিচারক দু’দিনের জন্য জেল হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তদন্তকারীদের বক্তব্য, শুক্রবার গভীর রাতে মূলত ওই তরুণীই লেক থানার এসআই রাহুল অধিকারীর উর্দি থেকে তাঁর নাম লেখা ফলকটি ছিঁড়ে নেন। পুলিশ সূত্রের খবর, সর্বজয়া নিজেকে এমবিএ-র ছাত্রী বলে দাবি করেছেন। তাঁর এই দাবি কতটা ঠিক, তা-ও পুলিশ খতিয়ে দেখছে।
পুলিশ জানায়, পাশের বাড়ির বাসিন্দা, বৃদ্ধা রেণু প্রামাণিকের অভিযোগের ভিত্তিতে একটি মামলা রুজু করা হয়েছে ওই ১১ জনের বিরুদ্ধে। তা ছাড়া, লেক থানার পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়েও (সুয়ো মোটো) একটি মামলা রুজু করেছে।
পুলিশ জানাচ্ছে, পার্টিতে শুধু ওই ১১ জনই ছিলেন না, আরও অনেকে ছিলেন। অনেকেই ছিলেন মত্ত অবস্থায়। তবে পুলিশ পৌঁছলে তাঁদের একাংশ পালিয়ে যান। ধৃতেরা কেউ নিজেকে চাকরিজীবী, কেউ পড়ুয়া, কেউ সঙ্গীতশিল্পী বলে দাবি করেছেন।
যেখানে শুক্রবার রাতে উদ্দাম পার্টি চলছিল, তার ঠিকানা ৪১-বি গড়িয়াহাট রোড। চারতলা ওই বাড়ির তিনতলা ও ছাদে ভাগ হয়ে চলছিল আমোদ। পুলিশ জেনেছে, সামিল ছিলেন জনা পঁচিশ তরুণ-তরুণী। ওই বাড়িটি সত্রাজিৎ ঘোষদাস নামে বছর চল্লিশের এক ব্যক্তির। শুক্রবার রাতে তিনি ও তাঁর বন্ধুবান্ধবীরাই পার্টিতে ছিলেন। সত্রাজিৎকে গ্রেফতার করা হলেও তিনি এ দিন জামিন পান।
পাড়ার লোকজনের বক্তব্য, ওই ব্যক্তি নিজেকে যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী বলে দাবি করতেন। ওই বাড়ি থেকে প্রায়ই গান ও যন্ত্রসঙ্গীত ভেসে আসত, কখনও কখনও রাত তিনটে-সাড়ে তিনটে পর্যন্ত। পাড়ার কেউ কেউ আপত্তি করলে তাঁদের শুনতে হয়েছে, অনুষ্ঠানের মহড়া চলছে।
ওই বাড়ির গা ঘেঁষা, ১/১ সাউথ এন্ড পার্কে একটি আবাসনের তিন তলার একটি ফ্ল্যাটে থাকেন রেণুদেবী ও তাঁর স্বামী শিবু প্রামাণিক, তাঁদের ছেলে, পুত্রবধূ ও দু’বছর ন’মাসের নাতি।
রেণুদেবীর কথায়, ‘‘পাশের বাড়ির যেখানে গানবাজনা হয়, ঠিক তার মুখোমুখি আমাদের ফ্ল্যাট। তাই, শব্দের যন্ত্রণা সব চেয়ে বেশি আমাদের পোহাতে হত। বছর দুয়েক যাবৎ এমনটা চলছে। বারবার বলেও সুরাহা হয়নি। কিন্তু শুক্রবার রাতে যা চলছিল, সেটা একেবারে তাণ্ডব।’’
পুলিশ জেনেছে, শুক্রবার রাতে শুধু গানবাজনার মহড়াই চলছিল না, জন্মদিনের পার্টিও ছিল। সেই জন্য অন্যান্য রাতের তুলনায় সব কিছু মাত্রাছাড়া হয়ে যায়।
তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, এর আগেও প্রামাণিক পরিবার থেকে লিখিত ভাবে লেক থানায় বিষয়টি জানানো হয়েছে। তবে প্রতি বারই তাঁরা ‘অসুবিধের কথা’ জানিয়েছেন, কোনও অভিযোগ দায়ের করেননি। সেই মতো লেক থানার পুলিশ সত্রাজিৎকে সতর্ক করে গিয়েছে। তাতে অবশ্য লাভ হয়নি।
রেণুদেবীর ছেলে সিদ্ধার্থ জানান, শুক্রবার সন্ধে সাতটা থেকে পার্টির নাচ-গান-হুল্লোড়ের শব্দ শুরু হয়। রাত সাড়ে ১২টা থেকে শুরু হয় তবলা। তার পরে অনেকগুলি গিটার এক সঙ্গে বাজতে থাকে। আর রাত ২টো থেকে সাউন্ড বক্সের বিকট শব্দ।
একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী সিদ্ধার্থের বক্তব্য, প্রথমে তাঁর মা ও তিনি ওই বাড়িতে যান, আওয়াজ বন্ধ করতে অনুরোধ করলেও সত্রাজিৎ ও অন্যেরা তাতে কর্ণপাত না করে পাল্টা বলেন, অন্যের বাড়িতে এত রাতে তাঁরা কেন এসেছেন? তার পরে তাঁদের ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়া হয়। সিদ্ধার্থের কথায়, ‘‘বেরিয়েই আমরা লেক থানায় খবর দিই। কিছুক্ষণের মধ্যেই চার জন পুলিশ ঢোকেন। পার্টির লোকজনের কেউ কেউ তখন পালাতে শুরু করে।’’
লেক থানা সূত্রের খবর, কয়েক জনকে ধরতে গেলে পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি শুরু, হয় সেই সময়েই এক অফিসারের নেমপ্লেট তাঁর উর্দি থেকে ছিঁড়ে নেওয়া হয়। তার পরে তিন জন মহিলা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছন। এক এক করে ১১ জনকে গ্রেফতার করে গাড়িতে তোলে পুলিশ।