প্রতীকী ছবি।
কলকাতায় আমি ২৫ বছর বয়স অবধি ছিলাম। তখনও পড়াশোনা করি, অল্প বয়স। ভোটের স্মৃতি যেটুকু রয়েছে তাতে মনে পড়ে যে খবরের কাগজ পড়তাম। তখন তো এত সংবাদমাধ্যম হয়নি। এই ভাবে প্রতি মুহূর্তে নির্বাচনের খবর পাওয়া যেত না। বাড়িতে সকলে বাম মনোভাবাপন্ন ছিলেন। সরাসরি দলের সঙ্গে যুক্ত না হলেও বাড়িতে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন বড়রা। দু’একবারই ভোট দিয়েছি। সকালে বাড়ির সদস্যদের সঙ্গে গিয়ে ভোট দিয়ে এসেছিলাম।
এর পরে ১৯৯৮ সালে ক্যালিফর্নিয়ায় চলে আসি। তখন ভোটাধিকার ছিল না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হয়েছি বারাক ওবামা ক্ষমতায় আসার আগের বছর, অর্থাৎ ২০০৮-এ। এখানে নির্বাচনের পদ্ধতিটা ভারতের থেকে একদমই আলাদা। মেজাজটাও আলাদা। উত্তেজনা অনেক কম। কেউ ভোটের দিন উপস্থিত না থাকলে ব্যালটটা ডাকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিতে পারেন। প্রথম বার আমিও সেটাই করেছিলাম। কারণ ভোটের দিন আমি কলকাতায় ছিলাম।
দু’দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় তফাত যেটা চোখে পড়ে সেটা হল ছুটি। ভারতে যেমন ভোটের দিন ছুটি থাকে, এখানে কিন্তু তেমনটা নয়। সমস্ত প্রতিষ্ঠান খোলাই থাকে, আর-পাঁচটা কাজের দিনের মতোই। এখানে ভোট দেওয়ার হার বেশ কম, ৪০ শতাংশের মতো। অথচ মানুষ রাজনীতি নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। এটা অদ্ভুত একটা ব্যাপার। ভোট দেওয়ার কম হার নিয়ে অনেক আলোচনাও হয়। অবশ্য ছুটি না থাকাটা একটা বড় কারণ। এটা বলা হয় যে এত কম মানুষ ভোট দেন বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে প্রকৃত গণতন্ত্র বলা যায় না। আমি শিক্ষিকা। আমার ছাত্র-ছাত্রীদের সব সময়েই ভোট দিতে উৎসাহিত করি। তবে ওরা বেশির ভাগই একাধিক আংশিক সময়ের কাজ করে। ফলে ক্লাস ও কাজ সামলে ভোট দিতে যাওয়ার সময় পায় না। যদিও কেউ ভোট দিতে যাওয়ার জন্য দেরি করে এলে চাকরিদাতারা আইনত কিছু বলতে পারেন না, অনেকেই সেই ঝুঁকিটা নিতে চান না।
ভারতের মতো এখানে দল দেখে ভোট দেওয়ার প্রবণতা খানিকটা কম। সাধারণ নির্বাচনে সরাসরি প্রার্থীকেই ভোট দিতে হয়। রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট দলের সদস্য হলেও সেই দলের প্রার্থীকে পছন্দ না হলে অন্য দলের প্রার্থীকে ভোট দেওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার এখানে। এখানে মানুষ স্থানীয় সমস্যা নিয়ে খুব সচেতন। সে সব নিয়ে বিভিন্ন রকম গণভোট (রেফারেন্ডাম) হয়।
সেখানেও ভোট দিতে হয়। ডাকে করে সমস্যা মেটাতে যা যা ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে তা পাঠিয়ে ডাক যোগে দেওয়া হয় বাড়িতে বাড়িতে। এ বার ভোটার হিসেবে আমাদের দায়িত্ব সেটা খুঁটিয়ে পড়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। অনেকেরই এই সময়টা থাকে না বলে ভোট দেওয়া হয়ে ওঠে না। কেউ আবার স্থানীয় নেতার সঙ্গে মনোভাবে মেলে না বলে নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। আমি ক্যালিফর্নিয়ার যে কুপারটিনো এলাকায় থাকি সেখানে যেমন সম্প্রতি অভিবাসীদের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে একটি বহুজাতিক প্রযুক্তি সংস্থার মূল দফতর তৈরি হওয়ার পরে। তাই এখানে পরিকাঠামো উন্নয়নে মল ও সুপার কমপ্লেক্স তৈরি হবে কি না, তা নিয়ে ভোটাভুটি হয়। এতে সুবিধা হল, বাসিন্দারা নিজেরাই বিভিন্ন সিদ্ধান্তে সরাসরি অংশ নিতে পারেন। এই ব্যবস্থার সমালোচনাও অবশ্য হয়।
ভারতের নির্বাচনের খবর এখন আর অত খুঁটিয়ে রাখা হয় না। তবে সারা পৃথিবীতেই একটা উগ্র দক্ষিণপন্থী মনোভাবের বাড়বাড়ন্ত দেখা যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও গত নির্বাচনে খানিকটা দেখা গিয়েছে সেটা। ভারতের নির্বাচনে হিংসা, মানুষের মৃত্যু খুব দুঃখ দেয়। ভারতবর্ষে গণতন্ত্র আছে। বহুদলীয় ব্যবস্থা খুব শক্তিশালী। আশা করি দেরি হলেও এই হিংসার আবহ থেকে এক দিন বেরিয়ে আসা যাবে।
(লেখিকা কলেজশিক্ষিকা)