মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
পাড়ার ছেলেরা বাড়ির কলিং বেল বাজিয়েছে বুঝলেই বৃদ্ধ বলে দিতেন, “বাড়িতে কেউ নেই।” এর পরে শত ডাকাডাকিতেও তাঁর আর উত্তর মিলত না। এত দিন বৃদ্ধের অভিযোগ ছিল, “পাড়ার পুজোর চাঁদা চাইতে আসা ছাড়া ওঁদের আর কাজ কী!” টানা লকডাউনের পরে অবশ্য ধারণা বদলেছে তাঁর। একগাল হেসে নবতিপর এখন বলছেন, “প্রথমে বুঝিনি। পরে দেখলাম, ওঁরা স্যানিটাইজ়ার আর মাস্ক দিতে এসেছেন।”
অন্য একটি ঘটনায় শয্যাশায়ী বৃদ্ধার একমাত্র ছেলে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। জ্বরের ঘোরে ছেলে ঘরেই পড়ে ছিলেন। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর কেউ ছিল না। শেষে উদ্ধারে নামলেন সেই পাড়ার পুজো কমিটির ছেলেরাই!
করোনা অতিমারির পরিস্থিতিতে পাড়ার লোকের ‘পাশে থাকার’ এই সব ঘটনাই ভিডিয়ো আকারে এ বার তুলে ধরতে চাইছে বেশ কয়েকটি পুজো কমিটি। বুধবারই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “ক্লাবগুলোকে অনুরোধ করব, আপনাদের পাড়াকে আপনারাই ভাল রাখুন। পুজো আসছে সামনে, পুজোগুলো করতে হবে তো! পুজো যদি করতে হয়, পাড়ার লোকগুলোকে এখন থেকেই একটু দেখে রাখুন।” মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার পরেই তাঁরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানাচ্ছেন ওই পুজোকর্তারা।
টালা বারোয়ারি পুজোর এ বার শতবর্ষ। পুজোর অন্যতম উদ্যোক্তা অভিষেক ভট্টাচার্য যেমন বললেন, “সারা বছর ক্লাবের তরফে জনসেবামূলক কাজ করা হয়। এ বার লকডাউনের মধ্যে কয়েক হাজার লোককে আমরা প্রতিদিন খাইয়েছি। আমপানের পরে সুন্দরবনের মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। পুজো যা-ই হোক, কমিটির ছেলেদের এই সব কাজ অবশ্যই আমরা দর্শকদের সামনে তুলে ধরব।” ত্রিধারা সম্মিলনীর পুজোকর্তা দেবাশিস কুমার আবার জানালেন, প্রতিবারই ক্লাবের জনসেবামূলক কাজের ছবি তাঁরা দর্শনার্থীদের সামনে তুলে ধরেন। এ বার করোনা এবং আমপানের মধ্যে ক্লাবের ছেলেরা যে কাজ করেছেন, তা আরও বেশি করে তুলে ধরার পরিকল্পনা করা হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরে। তাঁর কথায়, “ত্রিধারার আশপাশের মানুষ জানেন ক্লাব তাঁদের জন্য সারা বছর কী করে। করোনা এবং আমপানে আমাদের ছেলেদের দায়বদ্ধতা আরও বেশি ছিল।”
লকডাউনে মানুষকে খাওয়ানো বা আমপান ত্রাণ তহবিলে সাহায্য তো বটেই, দেশপ্রিয় পার্কের পুজো উদ্যোক্তা সুদীপ্ত কুমার আবার বলেন, “কলকাতার পুজো কমিটিগুলির উচিত যত কম খরচে দৃষ্টিনন্দন পুজো করা যায়, সেটা দেখা। ছোট পুজো করে বাকি টাকা কর্মহীনদের সাহায্যে লাগানো হোক। তুলে ধরা হোক দুর্দিনে মানুষের পাশে থাকার চিত্র।”
সব পুজো কমিটিই জানাচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী বলার পর থেকেই যে তাঁরা কাজ শুরু করেছেন এমন ব্যাপার নয়। তাঁদের কাজ চলে সারা বছর। বালিগঞ্জ কালচারালের অন্যতম পুজো উদ্যোক্তা অঞ্জন উকিল জানালেন, লকডাউনের শুরুতে গড়িয়াহাট এবং লেক মার্কেটে স্যানিটাইজ়ার, মাস্ক বিতরণের পাশাপাশি আমপানের পরে জেসিবি নিয়ে গাছ কেটে রাস্তা সাফ করিয়েছেন তাঁরা। তিনি বলেন, “সারা বছর ধরে মানুষের পাশে থাকার কাজ করা স্রেফ পুজো করব বলে নয়।” নাকতলা উদয়নের পুজো উদ্যোক্তা বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, “আমাদের ক্লাবের ছেলেরা সুন্দরবনের দু’টো গ্রামের দায়িত্ব নিয়েছেন। আমাদের পুজোয় গ্রাম থেকে কাজে আসেন এমন লোকেদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। স্রেফ পুজোর জন্য এ সব নয়।”
উত্তর কলকাতার জগৎ মুখার্জি পার্কের পুজো উদ্যোক্তা দ্বৈপায়ন রায় আবার খাবারের পাশাপাশি সুন্দরবনের মানুষদের পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী হয়তো পুজো কমিটিগুলিকে পুরনো দায়িত্বই মনে করিয়ে দিয়েছেন।” পাড়ায় একটি হেল্পলাইন নম্বর চালু করার কথা জানিয়ে তেলেঙ্গাবাগান পুজো কমিটির অন্যতম কর্তা মধু সাহা বলেন, “আমাদের পাড়া কন্টেনমেন্ট জ়োন। হাতের কাছে এমন একটা নম্বর থাকা যে কত কাজের, তা উপলব্ধি করছেন পাড়ার প্রবীণেরা।”
আরও পড়ুন: অক্সফোর্ডের করোনা টিকা অক্টোবরেই? সেই চেষ্টাই চলছে, বলছেন বিজ্ঞানীরা
যদিও বাগবাজারের পুজোকর্তা সুবল পালের মন্তব্য, ‘‘সারা বছরের মতো এই পরিস্থিতিতেও আমরা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। সেটা অন্য প্রশ্ন। কিন্তু পুজোটা এ বার কী রকম হবে, সত্যিই বোঝা যাচ্ছে না।”
ফোরাম ফর দুর্গোৎসবের সাধারণ সম্পাদক তথা হাতিবাগান সর্বজনীনের অন্যতম পুজোকর্তা শাশ্বত বসুর আশ্বাস, “পুজো কমিটিগুলিকে আমরা পুজো করতে অবশ্য পালনীয় ১৭ দফা প্রস্তাব পাঠিয়েছি। সেগুলি মেনে চললেই পুজো করায় সমস্যা হওয়ার কথা নয়। মানুষকে সচেতন করে মুখ্যমন্ত্রীও কার্যত পুজোর অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন।”