মায়ের মৃত্যুর পরেই বদলায় জীবনযাত্রা

আগে সবাই স্বাভাবিক ছিলেন। পার্থ, দেবযানী নিয়মিত স্কুলে যেতেন স্কুলগাড়িতে। বাড়ির গাড়ির জন্য চালক ছিলেন। অরবিন্দ দে নিয়মিত গল্ফ খেলতে বেরোতেন। আর তাঁর স্ত্রী আরতি মেলামেশা করতেন সকলের সঙ্গে। পোষ্য ল্যাব্রাডর দু’টি যখন ছোট ছিল, তখন বাড়ি লাগোয়া বাগানে তাদের নিয়ে বেড়াতে আসতেন আরতি। গা লাগোয়া ভাই অরুণ দে-র বাড়িতেও নিয়মিত যাতায়াত ছিল অরবিন্দবাবুর ও তাঁর পরিবারের।

Advertisement

সুনন্দ ঘোষ

শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৫ ০০:৩৬
Share:

রবিনসন স্ট্রিটে অরবিন্দ দে-র বাড়ি।

আগে সবাই স্বাভাবিক ছিলেন। পার্থ, দেবযানী নিয়মিত স্কুলে যেতেন স্কুলগাড়িতে। বাড়ির গাড়ির জন্য চালক ছিলেন। অরবিন্দ দে নিয়মিত গল্ফ খেলতে বেরোতেন। আর তাঁর স্ত্রী আরতি মেলামেশা করতেন সকলের সঙ্গে। পোষ্য ল্যাব্রাডর দু’টি যখন ছোট ছিল, তখন বাড়ি লাগোয়া বাগানে তাদের নিয়ে বেড়াতে আসতেন আরতি। গা লাগোয়া ভাই অরুণ দে-র বাড়িতেও নিয়মিত যাতায়াত ছিল অরবিন্দবাবুর ও তাঁর পরিবারের। বাড়ির ৩০ বছরের পুরনো দারোয়ান মহেন্দ্র মণ্ডল দেখতেন, মায়ের হাত ধরে দুই ভাইবোন কাকার বাড়িতে আসতেন। বাইরে বেড়াতে যেতেন। দু’বাড়ির মাঝে টেবিলে বসে পিয়ানো বাজাতেন দেবযানী। সেই সুর কানে আসত মহেন্দ্রর।

Advertisement

এ সবই ওলটপালট হয়ে যায় আরতিদেবীর মৃত্যুর পরে। আরতিদেবীকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার সময়ে মহেন্দ্র যাননি। পার্থর বন্ধুরা ছিলেন। বাড়ির গেটে পাহারায় বসে মহেন্দ্র দেখেছেন, সেই মৃত্যুর পর থেকে ধীরে ধীরে বদলে গিয়েছিল পার্থদের জীবনযাত্রা। আরতিদেবীর মৃত্যুর পরে দু’বছর যেতে না যেতেই সমাজ থেকে নিজেদের একেবারে সরিয়ে নেন বাবা-মেয়ে-ছেলে। মহেন্দ্রর কথায়, ‘‘অরবিন্দবাবুর স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে আর ওঁদের সে ভাবে বাইরে বেরোতে দেখা যেত না। অরবিন্দবাবু বেরোতেন, তবে খুবই কম। মাসে এক বার, কখনও দু’বার গাড়ি নিয়ে বেরোতেন। কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসতেন। পার্থ আর দেবযানীকে প্রায় দেখাই যেত না।’’

পুরনো বনেদি বাড়ি। অনেকটা জমি নিয়ে। বাড়ির একপাশে দারোয়ান আর পরিচারকদের আলাদা কোয়ার্টার। সেখানে পাশাপাশি খুপরি ঘর। এমনই একটি ঘরে থাকেন দ্বারভাঙার বাসিন্দা মহেন্দ্র। তিনি আদতে অরুণবাবুর বেতনভুক কর্মচারী। তাঁর পাশে একটি ঘরে থাকেন ওড়িশার দেবরাজ নায়েক। তিনিও অরুণবাবুর বাড়িতে ঝাড়পোঁছের কাজ করেন। বাকিটা সময়ে কলকাতা পুরসভায় চাকরি করেন। পরিচারকদের কোয়ার্টারের একাংশ সামান্য উন্নত করে ভাড়া দেওয়া রয়েছে। সেই ভাড়াও নেন অরুণবাবু। মহেন্দ্র-সহ এঁদের কারও সঙ্গে কোনও সম্পর্কই ছিল না অরবিন্দবাবুদের। মহেন্দ্র ছোটবেলার পার্থর সঙ্গে কখনও সখনও কথা বলেছেন। কিন্তু, যুবক পার্থর সঙ্গে বাড়ির এত দিনের পুরনো দারোয়ানের কোনও বাক্যালাপ কখনও হয়নি। মহেন্দ্র জানান, ছ’মাস আগে পর্যন্ত তাঁকে বেতন দিতেন অরুণবাবুর মা। যিনি সম্প্রতি মারা গিয়েছেন। মহেন্দ্রর কথায়, সেই শান্তিদেবীকেই গোটা বাড়ির মালকিন বলে চিনতেন তিনি ও অন্য পরিচারকেরা। অথচ, স্ত্রীর মৃত্যুর পরে অশীতিপর সেই মাকেও দেখতে আসতেন না অরবিন্দবাবু। কার্যত দরজায় খিল তুলে দিয়েছিলেন তাঁরা।

Advertisement

তা হলে কী ভাবে চলত তাঁদের?

আরতিদেবীর মৃত্যুর পরে বাড়িতে পাকাপাকি ভাবে দু’জন বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগ করেছিলেন অরবিন্দবাবু। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা। আবার রাত ৮টা থেকে পরদিন সকাল ৮টা। দু’জন একটানা বসে থাকতেন বাড়ির দরজায়। একতলা থেকে দোতলায় ওঠার মুখে পথ আটকাতেন তাঁরা। সেই রক্ষীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, গত বেশ কয়েক বছর ধরে অরবিন্দবাবুর বাড়িতে রান্না-বান্নার পাট তুলে দেওয়া হয়েছিল। সকাল-বিকেল বাইরে থেকে খাবার আনানো হত ওই রক্ষীদের দিয়ে। কখনও বেশি বেশি খাবার এনে বাড়িতে মজুত রাখা হত। কোনও ঠিকে কাজের লোক ছিলেন না? রক্ষী হরেন্দ্র হাঁসদা প্রবল জোরে ঘাড় নেড়ে জানান, কাউকে বাড়ির ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হত না। কয়েক দিন অন্তর তাঁদেরই কারও হাত দিয়ে জামাকাপড় ধোপার বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন। বাসন-কোসন সম্ভবত নিজেরাই সাফ করে নিতেন। ঘর-দোর আদৌ সাফ করতেন কি না, সে বিষয়ে রক্ষীরাও অন্ধকারে।

রক্ষী সুশান্ত হাজরার কথায়, ‘‘কখনও খাবার, কখনও বা অন্য ছোটখাট ফাই-ফরমাস নিয়ে উপরে গিয়ে যখন বেল বাজাতাম, দরজা ফাঁক হত ‘এই এতটুকু।’’ হাত ছোট করে দেখান সুশান্ত। হাত বাড়িয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে, বা কোনও নির্দেশ দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হত দরজা। ফলে ঘরের ভিতরে কী রয়েছে, কী অবস্থায় রয়েছে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রয়েছে কি না, তা কখনওই তাঁদের চোখে পড়েনি। কলা, রুটি, ভাত, মাছের ঝোল থেকে পিৎজা, ফ্রায়েড রাইস— সবই ছিল খাবারের তালিকায়। যখন যে রকম মর্জি হতো খাবার আনাতেন পার্থ। মোবাইল ফোনে কাছের একটি হোটেলে অর্ডার দিয়ে দিতেন। রক্ষীরা নিয়ে আসতেন।

মহেন্দ্র ও রক্ষীদের মতে, পার্থদের চালচলন তাঁদের কাছে অস্বাভাবিক লাগতো ঠিকই, কিন্তু নেপথ্যে যে এত বড় কাণ্ড ঘটে গিয়েছে তা ঘূণাক্ষরেও টের পাননি তাঁরা। মাস দুয়েক আগে থেকে পার্থর ব্যবহারে অস্বাভাবিকতা বেশি করে পরিস্ফুট হতে শুরু করে। মাঝে মধ্যে আচমকা একটানা চেঁচিয়ে উঠতেন তিনি। অব্যক্ত যন্ত্রনায় যে ভাবে মানুষ গলা ছেড়ে চিৎকার করে ওঠে, অনেকটা সেরকমই। বুধবার রাতে অরবিন্দবাবুর মরদেহ পুলিশ নিয়ে যাওয়ার পরে ওই ভাবে চিৎকার করে উঠেছিলেন পার্থ। তা ছাড়া, ইদানীং আচমকাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতেন পার্থ। রাস্তায় বেরিয়ে যেতেন। তাঁর সেই অস্বাভাবিক আচরণ দেখে রক্ষীদের একজন কখনও তাঁর পিছনে হেঁটেও গিয়েছেন। দেখা গিয়েছে, কখনও কাছের ডাকঘরে, কখনও মিষ্টির দোকানে গিয়ে কিছুক্ষণ পরে আবার ফিরে এসেছেন তিনি। অরবিন্দবাবুও বেরোতেন। তবে, খুব কম। বছর দুয়েক আগেও গাড়ি নিয়ে তিনি বেরোতেন। কিন্তু, সম্প্রতি বেরোতেন ট্যাক্সি নিয়ে।

রক্ষী সুশান্তবাবু বলেন, ‘‘এই তো ক’দিন আগে উপর থেকে পার্থবাবু বলেছিলেন নীচে গাছে ফুল হয়েছে। সেখান থেকে ফুল নিয়ে আসতে। আমি ফুল নিয়ে যেতেই আবার আমার উপরে খুব রেগে গেলেন। চিৎকার করে বলতে শুরু করলেন, ‘কে বলেছে গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে আনতে? কে বলেছে লাল ফুল আনতে?’ আমি চুপ করে নীচে নেমে এলাম।’’

অথচ কয়েক বছর আগেও এমনটা ছিল না। বেঙ্গালুরুর একটি সংস্থার ডিরেক্টর পদে ছিলেন অরবিন্দবাবু। ১৯৮৭ সালে অবসর নিয়ে চলে আসেন কলকাতায়। এখানে রবিনসন লেনের পৈতৃক বাড়িতে ১৯৮৯ সাল থেকে পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করেন সপরিবারে। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার অরবিন্দবাবু অনেক যত্নে বড় করেছিলেন দুই ছেলে-মেয়েকে। দু’জনেই বি-টেক। যদিও, সঙ্গীত ছিল দেবযানীর ধ্যান-জ্ঞান। কলকাতার নামী স্কুলে সঙ্গীতের শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করতেন। তাঁর আঙুলের ছোঁয়ায় বেজে উঠত পিয়ানো। ঘরের ভিতরে রয়েছে আরও অনেক ধরনের বাদ্যযন্ত্র। কি-বোর্ড, পিয়ানো। রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সাউন্ড-সিস্টেম। আর রয়েছে বই। অজস্র বই। যার মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বই যেমন রয়েছে, তেমনই আছে আধ্যাত্মবাদের বহু বইও। মহেন্দ্রর কথায়, ‘‘স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে সুখের সংসার ছিল অরবিন্দবাবুর।’’

আপনি কি জানেন পার্থবাবু পুলিশকে বলেছেন, দেবযানী মারা গিয়েছেন ডিসেম্বরে? অবাক হয়ে যান মহেন্দ্র। ছলছল করে ওঠে তাঁর চোখ। বলেন, ‘‘কী বলছেন? কয়েক দিন আগেও নীচে ওই গার্ডদের জিজ্ঞাসা করলাম, বাড়ির সকলে এমনিতে ভাল আছেন? তিনি তো বললেন, হ্যাঁ। অবশ্য উনিই বা জানবেন কী করে?’’ পাশে বসে দেবরাজও কেমন হতবাক হয়ে যান। পার্থর কথা অনুযায়ী ২০১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর দেবযানী যে মারা গিয়েছেন এবং তার পর থেকে ওই বাড়ির একটি ঘরে যে সযত্নে রাখা ছিল তাঁর দেহ, তাঁরা তো তা বুঝতেই পারেননি ছ’মাস ধরে। কখনও সামান্যতম সন্দেহজনক গন্ধও নাকে এসে লাগেনি।

এত দিন কেউ কিছু জানতেন না। কিন্তু এ ঘটনার অভিঘাতে এখন টালমাটাল রবিনসন স্ট্রিটের পুরনো বাসিন্দারা। এ তল্লাটেই ছোটবেলা কাটিয়েছেন অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। দে বাড়ির দু’টি বাড়ি তফাতে তাঁদের আবাসন। যেখানে তাঁর মা ও ভাই থাকেন। ঋতুপর্ণা বলেন, ‘‘কয়েক বছর আগে আমাদের আবাসনে এক বৃদ্ধার আস্বাভাবিক মৃত্যুতে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছিল। এর পরে আবার আজকের এই ঘটনা। বার বার এ রকম ঘটনায় তো মানুষের মধ্যে এই পাড়া সম্পর্কেই নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে। যা এ রকম একটি অভিজাত এলাকার সঙ্গে একেবারেই মানানসই নয়। এখনও এই পাড়ায় অনেক বয়স্ক মানুষ আছেন। এঁরা অনেকেই একা থাকেন। ছেলেমেয়েরা থাকেন দূরে, বিদেশে। এ ধরনের ঘটনা বয়স্কদের আতঙ্কের কারণ হয়ে ওঠে। এ রকম চলতে থাকলে এ বার কি রবিনসন স্ট্রিট পাড়াটাই ক্রমশ অভিশপ্ত পাড়া হিসেবে চিহ্নিত হবে?’’

ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement