প্রহরী: পুজোর শহরে মহিলাদের নিরাপত্তা দিতে এ ভাবেই সক্রিয় ছিলেন কলকাতা পুলিশের মহিলা বাহিনী। নিজস্ব চিত্র
অষ্টমীর রাত সাড়ে ৩টে। ঢাকুরিয়া ব্রিজে যেন সিনেমার শুটিং চলছে! মোটরবাইকে সওয়ার পাঁচ যুবকের পিছনে চারটি স্কুটিতে চার মহিলা পুলিশকর্মী। খানিক দূর ধাওয়া করে এক হাতে স্কুটি চালাতে চালাতে একটি ছেলের শার্ট টেনে ধরলেন এক পুলিশকর্মী। চলন্ত যানে বসে ওই ভাবেই টানা-হেঁচড়া চলল কয়েক মুহূর্ত। এর পরে বাধ্য হয়ে বাইক থামাল যুবকের দল। এক মহিলা পুলিশকর্মী বললেন, ‘‘চল এ বার। পুজো দেখাব!’’
পুজোর শহরে মহিলাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এমন ভাবেই দাপিয়ে বেড়ালেন কলকাতা পুলিশের নতুন মহিলা দল ‘দ্য উইনার্স’। মহিলাদের হেনস্থা এবং উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে ওই পুলিশকর্মীদের তৎপরতায় গ্রেফতার হয়েছেন আট জন। পুজোর মরসুমে তাঁদের হাতে আটক হয়েছিলেন অন্তত ৩২ জন। পুজোর শহরে কাজের এমনই নানা অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছিলেন ‘উইনার্স’-এরই এক সদস্য। বললেন, ‘‘অষ্টমীর রাতে এক তরুণীকে জোর করে বাইকে তোলার চেষ্টা করছিলেন কয়েক জন যুবক। তাঁদের ধাওয়া করে ঢাকুরিয়া ব্রিজের উপরে আমরা ধরে ফেলি।’’ তিনি জানান, একডালিয়া এভারগ্রিনের ভিড়টা ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন্সে এসে তখন ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। একা হাঁটছিলেন
এক তরুণী। গায়ে শার্ট আর ট্রাউজার্স। তিনটি মোটরবাইকে জনা পাঁচেক যুবক ওই তরুণীর পিছু নেন। ধেয়ে আসে একের পর এক অশালীন মন্তব্য। একটি স্কুলের সামনে তরুণীর পথ আটকায় বাইক-সহ যুবকের দল। দাবি, তাঁদের সঙ্গে মোটরবাইকেই যেতে হবে তরুণীকে। শুরু হয় তরুণীর হাত ধরে টানাটানিও। সেই রাতে গড়িয়াহাট মোড়ে ছিল ‘উইনার্স’-এর চার জনের একটি দল। সেই দলেরই এক পুলিশকর্মীর কথায়, ‘‘আমরা গিয়ে কথা বলতেই পালানোর চেষ্টা করেন ওই যুবকেরা। তবে বেশি দূর যেতে পারেননি। ঢাকুরিয়া ব্রিজেই ধরা পড়ে যান সকলে। গাড়ি চালাতে চালাতেই আমাদের এক জন একটি ছেলের শার্ট টেনে ধরেন।’’ এর পরে লেক থানার পুলিশের হাতে ওই যুবকদের তুলে দেওয়া হয়। তরুণীকেও বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন ‘উইনার্স’ দলের সদস্যেরা।
এটিই একমাত্র নয়। পুজোর মরসুমে মহিলাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে রাত-দিন কাজ করেছেন তাঁরা। ভবানীপুর থানায় বসে উইনার্স দলের এক সদস্য বলেন, ‘‘সপ্তমীর রাতে এক অদ্ভুত ছেলেকে ধরলাম ম্যাডক্স স্কোয়ার থেকে। হাজার বার বারণ করা সত্ত্বেও কয়েক জন তরুণীর ছবি তুলেই যাচ্ছিল সে।’’ তরুণীরা ওই যুবককে ছবি তুলতে বারবার বারণ করেছিলেন। তবু তিনি শোনেননি। মণ্ডপ এবং মণ্ডপ চত্বর পেরিয়ে রাস্তায় চলে এলেও ছবি তুলেই যাচ্ছিলেন যুবক। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ‘উইনার্স’ দলের এক সদস্যকে বিষয়টি জানান এক তরুণী। ধরা পড়ার ভয়ে ছুটতে শুরু করেন যুবক। তাঁর পিঠে থাকা ব্যাগ মহিলা পুলিশকর্মীর হাতে চলে এলেও ব্যাগ ফেলেই পালানোর চেষ্টা করেন যুবক। শেষ রক্ষা অবশ্য হয়নি। মারধর খেয়ে মাটিতে বসে পড়ে যুবককে বলতে শোনা যায়, ‘‘ওঁরা আমার বোনের মতো। ভাল লাগছে দেখতে, তাই ছবি তুলে দিচ্ছিলাম!’’ মধ্য কলকাতার মহম্মদ আলি পার্কে আবার মণ্ডপের ভিতরেই এক মহিলাকে জড়িয়ে ধরার অপরাধে গ্রেফতার হয়েছেন এক যুবক। তা-ও হয়েছে ‘উইনার্স’-এর তৎপরতায়।
কলকাতা পুলিশের ডিসি (দক্ষিণ) মিরাজ খালিদ বলেন, ‘‘পুজোর মধ্যে উইনার্স দলের সদস্যেরা যে কাজ করেছেন, সে জন্য তাঁদের কুর্নিশ। হেনস্থা হওয়ার পরে মহিলারা থানায় গিয়ে অভিযোগ জানাবেন, এই ভাবনায় বদল আনার চেষ্টা করা হয়েছে। উইনার্স দলই সর্বক্ষণ ভিড়ের মধ্যে মহিলাদের পাশে থাকবে। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে ঘটনাস্থল থেকেই।’’
সর্বক্ষণ মহিলাদের পাশে থাকার ভাবনা থেকেই গত জুলাইয়ে ‘দ্য উইনার্স’ তৈরি করে কলকাতা পুলিশ। দু’জন সাব-ইনস্পেক্টর পদমর্যাদার অফিসারের পাশাপাশি ‘উইনার্স’-এ রয়েছেন ২৫ জন মহিলা পুলিশকর্মী। গত মার্চ মাসে নিয়োগের পরে কলকাতা পুলিশ ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শুরু হয় তাঁদের। মার্শাল আর্টসের পাশাপাশি আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারেও সিদ্ধহস্ত ‘উইনার্স’-এর সদস্যেরা। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান প্রবীণ ত্রিপাঠী বলেন, ‘‘মহিলাদের পাশে থাকাই শুধু নয়, উৎসবের মরসুমে উইনার্স এক নজির সৃষ্টি করেছে। আসন্ন কালীপুজোয় একই ভাবে রাস্তায় থাকবে উইনার্স।’’