ব্যবস্থা নেই, ভাগ্যের হাতে মরণাপন্নদের ডায়ালিসিস

গত বছর ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছিল আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী মালিনী বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কোমায় চলে যাওয়া মালিনীর ডায়ালিসিসের ব্যবস্থা ছিল না হাসপাতালে। ফলে শহরের অন্য বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল তাঁকে।

Advertisement

জয়তী রাহা

শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৬ ০২:২৮
Share:

গত বছর ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছিল আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী মালিনী বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কোমায় চলে যাওয়া মালিনীর ডায়ালিসিসের ব্যবস্থা ছিল না হাসপাতালে। ফলে শহরের অন্য বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল তাঁকে। হাসপাতালের চিকিৎসকেরাই স্বীকার করেছেন, ওই ধকল মুমূর্ষু মালিনী নিতে পারেননি। অকালেই চলে গিয়েছিলেন তিনি।

Advertisement

মালিনীর উদাহরণ বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। হাওড়ার বাসিন্দা, অ্যাকিউট প্যাংক্রিয়াটাইটিসের শিকার সুদীপ দত্তকেও সম্প্রতি একই কারণে ফিরিয়ে দিয়েছেন আরজিকর কর্তৃপক্ষ। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সুদীপবাবু শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়ে কোমায় চলে যান। সেই সঙ্গে চলছিল ডায়ালিসিস। আকাশ ছোঁয়া বিলে সর্বস্বান্ত পরিবার সুদীপবাবুকে আরজিকরে ভর্তি করাতে গেলে কর্তৃপক্ষ জানান, ভেন্টিলেশনের রোগীর ডায়ালিসিসের পরিকাঠামো তাঁদের নেই। শুধু আরজিকর নয়, পিজি বাদে রাজ্যের আর কোনও মেডিক্যাল কলেজেই এই পরিষেবা নেই।

এসএসকেএমের অবস্থাও সঙ্গীন। সেখানে সীমিত পরিকাঠামোয় অল্প কয়েক জন রোগীকেই এই সুবিধা দেওয়া যায়। বাকিদের ফেরত পাঠানো হয়। সেই সীমিত পরিকাঠামোতেও মাঝেমধ্যেই বিকল হয়ে থাকে একাধিক যন্ত্র। ফলে মুমূর্ষু রোগীদের ভোগান্তির শেষ থাকে না। এই পরিষেবা তাঁরা কত রোগীকে দিতে পারছেন? হাসপাতালের অধিকর্তা মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এত সব তথ্য আমার কাছে নেই।’’ এই পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য স্বাস্থ্য ভবনে কোনও আবেদন কি তাঁরা করেছেন? মঞ্জুদেবীর জবাব, ‘‘ঠিক খেয়াল নেই।’’

Advertisement

কী এই বিশেষ ডায়ালিসিস যার জন্য মানুষের এমন ভোগান্তি? ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ সুগত দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘সাধারণ ডায়ালিসিস আর ভেন্টিলেশন রোগীর ডায়ালিসিসে পদ্ধতিগত পার্থক্য আছে। ভেন্টিলেশন রোগীর অনিয়মিত রক্তচাপের সমস্যা থাকে। পাম্প করে রক্ত বার করা এবং বিশুদ্ধ রক্ত দেওয়ার কাজ সাধারণ রোগীর থেকে অনেক ধীর গতিতে করতে হয়। না হলে প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে। এর জন্য ‘স্লো লো-এফিশিয়েন্সি ডায়ালিসিস’ মেশিন দরকার।’’

চিকিৎসকদের একাংশ বলছেন, সাধারণ ডায়ালিসিস যন্ত্রেও বিশেষ প্রক্রিয়ায় ভেন্টিলেশনে থাকা রোগীর ডায়ালিসিস সম্ভব। কিন্তু সে ক্ষেত্রে রোগীর শয্যার পাশে ২৪ ঘণ্টা এই ব্যবস্থা থাকা জরুরি। কারণ, আট থেকে বারো ঘণ্টা ধরে আস্তে আস্তে চালাতে হয় ডায়ালিসিস। মুমূর্ষু রোগীর যখন তখন ডায়ালিসিসের প্রয়োজন হতে পারে। চিকিৎসকদের মতে, ভেন্টিলেশনে থাকা, তুলনায় ভাল রোগীকেও স্ট্রেচারে অন্যত্র নিয়ে যেতে শারীরিক সমস্যা শুরু হতে পারে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান যা কোনও ভাবেই সমর্থন করে না।

যেখানে মেডিক্যাল কলেজগুলিতে এত নতুন পরিষেবা চালু হচ্ছে, সেখানে ডায়ালিসিসের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি কেন বাদ গেল? এনআরএসের অধ্যক্ষ দেবাশিস ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ভেন্টিলেশনে থাকা রোগীকে ডায়ালিসিস ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হবে না, ইউনিট রোগীর পাশে আনা হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় রোগীর অবস্থা দেখে। ডায়ালিসিসের জন্য প্রচুর জল লাগে। শয্যার পাশে জলের ব্যবস্থা থাকাও জরুরি। সীমিত পোর্টেবল ডায়ালিসিস যন্ত্র এবং জলের লাইনের অভাবে বেশির ভাগ সময়েই বেডসাইড ডায়ালিসিস দেওয়া সম্ভব হয় না।’’

মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ তপনকুমার লাহিড়ী বলেন, ‘‘ভেন্টিলেশনে থাকা রোগীর শয্যার কাছে ডায়ালিসিসের ব্যবস্থা নেই। পাশেই ডায়ালিসিস ইউনিট থাকায় সেখানেই রোগীকে নিয়ে যাওয়া হয়। বিকেল বা রাতে প্রয়োজন হলে খুবই সমস্যায় পড়তে হয়।’’

ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজেও এই পরিষেবা নেই। এমনকী, খাস কলকাতা শহরের এই মেডিক্যাল কলেজটিতে নেই নেফ্রোলজিস্টও। অধ্যক্ষ মঞ্জুশ্রী রায় স্বীকার করেছেন, ‘‘ভেন্টিলেশনে থাকা রোগীকেও পোর্টেবল ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে ডায়ালিসিস ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হয়। মুমূর্ষুদের ক্ষেত্রে সেটা খুবই সমস্যার।’’ মঞ্জুদেবী জানান, বিষয়টি একাধিক বার তাঁরা স্বাস্থ্য দফতরকে জানিয়েছেন।

এ ব্যাপারে কী ভাবছে স্বাস্থ্য দফতর? স্বাস্থ্য অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সব সরকারি হাসপাতালেই ভেন্টিলেশনের রোগীর ডায়ালিসিস চালুর চিন্তা-ভাবনা হয়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় নেফ্রোলজিস্ট অনেক কম। আমরা চেষ্টা করছি। কিন্তু কবে তা বাস্তবায়িত হবে, এখনই বলা সম্ভব নয়।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement