সৃজন: পথের দু’ধারে চলছে মূর্তি তৈরির যজ্ঞ। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
বকের মতো দাঁড়িয়ে পা ফেলার জায়গা খুঁজছিলেন আগন্তুক। আচমকা প্লাস্টিকের আবডাল থেকে উড়ে এল প্রৌঢ়ের সতর্কবাণী, “আকাশের যা অবস্থা, আবার নামবে। মাটি গলে পিছল হয়ে আছে। সাবধানে যান।” বড্ড চেনা সেই পথই কিন্তু দ্রুত পেরিয়ে যায় বছর পাঁচেকের খুদে।
গলে যাওয়া মাটি আর ছড়ানো বিচুলির মাঝে তখন মগ্ন বিশ্বকর্মারা। কাঠামোয় শক্ত করে বিচুলি বাঁধার কাজ চলছে। কোথাও আবার চিটে মাটি অর্থাৎ এঁটেলের সঙ্গে তুষ মিশিয়ে বিচুলির উপরে একমেটে চলছে। স্কুলের পোশাকে দুই কিশোর পাট কুচিয়ে এঁটেল মাটিতে মেশাচ্ছিল। “স্কুলে যাওনি?” “ছুটি হয়ে গেছে,” মাথা তুলে উত্তর দিল এক জন। এই মাটি দিয়ে কী হবে? পাশে দাঁড়ানো এক মধ্যবয়স্কা হাসতে হাসতে বললেন, সরু নিপুণ আঙুল যাতে না ভাঙে তাই এই ব্যবস্থা।
কয়েক পা এগোতেই নজরে পড়ল, এঁটেল আর বেলে মাটি ছাঁচে ফেলে তৈরি হচ্ছে মুখ। এর মধ্যে তুষের মাটির আস্তরণ পড়বে। সেই মাটি দিয়ে বানানো হবে খুলিও।― বলে উঠলেন শিল্পী। তাঁর এক হাতে তখন দিন দুয়েক আগে তৈরি মুখ। অন্য হাতে ধরা বাঁশের চিয়ারি। তারই ঘষায় ভোরের আলো ফোটার মতো একটু একটু করে পরিষ্কার হচ্ছে অবয়বের চোখ-নাক।
সবে তো শুরু। প্রতি বারের মতোই রথের পর থেকে আরও বায়নার চাপে জমজমাট হতে থাকে কুমোরটুলি। বাড়ে ছবি-শিকারি আর সাংবাদিকদের ভিড়। প্রতি বারের এক চিত্র, তবু একঘেয়েমি পাবেন না। এ যেন বাঙালির পাতে ভাত-ডাল-মাছ।― বলে উঠলেন এক কারিগর। আক্ষরিক অর্থে বছরভর তারই জোগানের আয়োজন চলে এখানে।
কালের স্রোতে আসা বিবর্তনকে সমঝে নিয়ে কুমোরটুলি আদতে বাস্তবের ফিনিক্স পাখি। গ্রিক পুরাণ মতে, হাজার বছর ধরে জীবনচক্রে আবর্তিত হয় এই অগ্নি-পাখি। সেই বিবর্তনের সাক্ষী গোবিন্দরাম মিত্র, নন্দরাম সেনের প্রভূত সম্পত্তি। এ অঞ্চলের ডাকসাইটে জমিদার, কালেক্টর ছিলেন এঁরা। শোনা যায়, প্রায় পঞ্চাশ বিঘা জায়গা জুড়ে ছিল গোবিন্দরামের আধিপত্য। এক দিকে, আবহমান কাল ধরে বহতা গঙ্গা। অন্য দিকে প্রাচীন জনপদ চিৎপুর বা রবীন্দ্র সরণি। তারই ধারে টিকে থাকা জোড়বাংলা শিবমন্দির তৈরি করেছিলেন গোবিন্দরাম। ১৭৩১ সালে তৈরি নবরত্ন মন্দির কয়েক বছরের মধ্যেই ভূমিকম্পে প্রায় ধ্বংস হয়। আজ যেটুকু আছে, তাতে হারিয়েছে স্থাপত্য।
পলাশির যুদ্ধের আগেও এখানে থাকতেন মাটির হাঁড়ি-বাসন তৈরির কারিগরেরা। সে সময়ে পেশা অনুযায়ী পাড়ার নাম হত। তেমনই ছিল কুমোরটুলি। ইংরেজদের বন্ধু হয়ে ওঠা শোভাবাজারের নবকৃষ্ণ দেব, ক্লাইভ ও তাঁর সম্প্রদায়কে খুশি করতে জাঁকিয়ে শুরু করেন দুর্গাপুজো। মূর্তি গড়তে কৃষ্ণনগর থেকে আসেন শিল্পী। সম্ভবত সেই শুরু কুমোরটুলিতে কৃষ্ণনগরের শিল্পীদের প্রবেশ। কাঁসা-পিতলের বাসন ধীরে ধীরে আটকে দিল কুমোরের চাকাকে। বাড়তে লাগল বাড়ির পুজো। বিংশ শতকের গোড়ায় জন্ম নিল বারোয়ারি পুজো। জমে উঠল কুমোরটুলি। বিংশ শতকের প্রথমার্ধে একচালার ঠাকুর গড়ার প্রথা থেকে বেরিয়ে পৃথক ঠাকুর গড়েন কৃষ্ণনগরের শিল্পী গোপেশ্বর পাল। তাঁর হাত ধরে সেই শুরু।
দেশভাগের সময়ে ঢাকার বিক্রমপুর থেকে পেশা রক্ষায় ভাইদের নিয়ে হাজির হয়েছিলেন রাখালচন্দ্র রুদ্রপাল। পরিবারটিকে কুমোরটুলিতে থাকতে সংগ্রাম করতে হয়েছিল। যাঁরা এলাকায় ঢুকতে পারেননি, তাঁরা কুমোরটুলির আশপাশেই স্টুডিয়ো গড়ে কাজ করতেন।
সেই কুমোরটুলিতে আজও রয়ে গিয়েছে বাঙাল-পট্টি, ঘটি-পট্টি। তবে ভেদাভেদ নেই। এমনকি বিয়েও হয়, বলছিলেন রুদ্রপাল বংশের এক তরুণ।
যে কোনও কিছুতেই নিয়ম ভাঙলে ঝড় উঠবেই। প্রথমে প্রবল বাধা পেলেও এখন শিল্পী হিসেবে মেয়েদেরও কাজের স্বীকৃতি মিলছে। তবে ভাঙছে পুরনো নিয়ম। দোলের দিনে পুজো করা গরান কাঠ, পতিতাগৃহের মাটি আজ আর কাজে লাগে না। এমনকি আগে ঠাকুর গড়তে শিল্পীকে সাদরে বাড়িতেই রাখত অনেক পরিবার। সে প্রথাও উঠেছে, বললেন শিল্পী চায়না পাল।
গত পনেরো বছর কুমোরটুলি ছেড়ে আসা বছর বাষট্টির সনাতন রুদ্রপালের কাছে জন্মস্থানের টান আজও টাটকা। বলে চলেন, প্রতিমার বায়নাদারদের থেকে নেওয়া ঈশ্বরবৃত্তি (মূর্তির উচ্চতা অনুযায়ী নেওয়া যে চাঁদা) আর নিজেদের চাঁদায় দোলের আগে-পরে বিশেষ পুজোয় মাতে কুমোরটুলি। ঘটি-বাঙালের এই উৎসবে কালী, শীতলা আর ব্রহ্মার পুজো হয়। বহু পুরনো এই পুজোয় আগে যাত্রা হত। তুলনায় নবীন বাঙালপট্টির বাসন্তী পুজো। যদিও সে পুজোয় মেতে ওঠেন সকলে। হাজার সমস্যা, মতান্তর সত্ত্বেও এই মেতে থাকাতেই যেন ওঁদের আনন্দ।
এ হল দেবতা গড়ার কারিগরদের নিজস্ব সংস্কৃতি। নিজস্ব কর্ম-সংস্কৃতির সেই পরিচয়েই পৃথিবীতে আলাদা সম্মান বাস্তবের এই ফিনিক্স পাখির।