তখনও গড়ের মাঠে ফোর্ট উইলিয়ামে উড়ছে ইউনিয়ন জ্যাক। এ দেশের প্রশাসনে, জনজীবনে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে নিজভূমে পরবাসী ভারতীয়রা। সেই তখনই মাঠফেরত এক বিকেলে হাজারও পাগল অনুরাগীবেষ্টিত এক দল ফুটবলযোদ্ধার মুখোমুখি জনৈক উপবীতধারী ব্রাহ্মণ।
খেলা তিনি দেখেননি। কিন্তু দিনভর মা কালীর কাছে প্রার্থনা করেছেন। এর পরে যুদ্ধজয়ী সেই স্বদেশীয় খেলোয়াড়দের প্রসাদি ফুল হাতে আশীর্বাদ করতে উপস্থিত তিনি। ময়দানি লোকগাথায় বহুচর্চিত সেই মুহূর্ত। যখন রূপকথার ফুটবলে ফৈজ়াবাদের বাঘা ব্রিটিশ মিলিটারি দল ইস্ট ইয়র্ক রেজিমেন্টকে কুপোকাত করে শিল্ডজয়ী মোহনবাগানের এক কুশীলব, বাঙালি খ্রিস্টান তরুণ সুধীর চাটুজ্জেকে ডেকে ব্রাহ্মণ বলছেন, ‘‘এটা তো হল, ওটা কবে টেনে নামাবে?’’ তাঁর তর্জনী উদ্যত সেই ইউনিয়ন জ্যাকের দিকে।
স্বাধীনতা দিবসের আগের এই পক্ষকাল বার বারই বাঙালির স্মৃতির অতলে ঘুমিয়ে থাকা কিংবদন্তি আর ইতিহাস ভাসিয়ে তুলেছে। ১৯১১-র ২৯ জুলাই খালি পায়ে সবুট গোরাদের হারিয়ে মোহনবাগানের ঐতিহাসিক আইএফএ শিল্ড জয়ের দিনটি এখন ‘মোহনবাগান দিন’ বলে চিহ্নিত। সে-যুগে দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকা, ‘দ্য বার্থ অব ইন্ডিয়ান ফুটবল’ শিরোনাম সাক্ষী, তা ভারতীয় ফুটবলের জন্মদিন বললেও বাড়াবাড়ি হয় না। এই অতিমারিধ্বস্ত বছরটিতেও নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কোয়্যারে মার্কিন স্টক এক্সচেঞ্জের বিলবোর্ডে সে-দিন দেখা গিয়েছে মোহনবাগানের প্রতীক ও নাম, ১৩১ বছরের বহতা ধারার স্মারক। আর তার তিন দিনের মধ্যেই বাঙালির বুকে বুকে জ্বলন্ত ইস্টবেঙ্গলের মশালও। ১ অগস্ট শতবর্ষ পার করেছে লাল-হলুদ শিবির।
একটা সময়ে পরাধীন বাঙালি যা মনে মনে চাইত তার অনেকটাই করে ফেলেছিল ফুটবলের শৌর্যে, ময়দানের সবুজ আঙিনায়। ‘দ্বিতীয় লন্ডন’ কলকাতায় বিলেতের ফৌজি খেলোয়াড়রা তখন ব্রিটিশ অলিম্পিক দলকেও ভরসা জুগিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া মোহনবাগান, মহমেডান, ইস্টবেঙ্গল সে সময়ে ছাপোষা গেরস্ত বাঙালির শৃঙ্গজয়ের স্বপ্নশরিক।
প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছেন, উপনিবেশ-যুগে সমগ্র পূর্ব এশিয়া জুড়ে আত্মপ্রত্যয় ফেরানোর নাম মোহনবাগান। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের চোখে ‘বন্দে মাতরম্’-এরও সমার্থক মোহনবাগান। আর দেশভাগ-উত্তর পশ্চিমবঙ্গে ছুঁয়েও ছুঁতে না-পারা মাতৃভূমির নামই ইস্টবেঙ্গল। স্বাধীনতা দিবসে ভারতের হয়ে-ওঠার আনন্দদিনটি আজও এক রাজনৈতিক ব্যবচ্ছেদের নাড়ি-ছেঁড়া যন্ত্রণায় আমাদের রক্তাক্ত করে। ঠিক তেমনই ইস্টবেঙ্গল নামটা আজও রাজনীতির ভাগাভাগির ইতিহাসের জ্বলন্ত দলিল। দেশভাগের পরে পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু বাঙালি সেই পতাকার নীচেই আশ্রয় নিয়েছিল।
বাঙালিয়ানার গণ্ডি ছাড়িয়ে ইস্ট-মোহন জুড়ে এখন বিদেশি কোচ, দেশ-বিদেশের তারকার দাপট। কর্পোরেট ঢেউয়ে সওয়ার হয়েই টাইমস স্কোয়্যারের ঘোষণা বলছে, এসেছে প্রত্যয়ের নতুন লগ্ন! তবু মান্না দে-র কবেকার ফিল্মি গান এই বিশ্বায়নের যুগেও সত্যি। সব খেলার সেরা বাঙালির ফুটবল মানে আজও ‘অমর হয়েছে নাম, মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল’! ছবি: সুমন বল্লভ
বিশ্বদর্শী
অনুবাদে ‘বাদ’ আছে, তরজমায় ‘জমা’। তাই ‘তরজমা’ই পছন্দ করতেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩৮-২০২০)। কবিতা দিয়ে লেখালিখি শুরু, তবে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান অজস্র গুরুত্বপূর্ণ তরজমাগ্রন্থ। একক প্রণোদনায় ‘ইউরোকেন্দ্রিক’ বাংলা অনুবাদচর্চায় এনে দিয়েছিলেন বিশ্বপ্রেক্ষিত। ল্যাটিন আমেরিকা-আফ্রিকা-পূর্ব ইউরোপ-পশ্চিম এশিয়ার বিরাট মানচিত্রকে ধরেছেন বাংলা ভাষায়। গল্প, উপন্যাস, নাটক-সহ সমস্ত সাহিত্যবর্গকে জরিপ করেছেন তরজমায়। ‘তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্য’ তাঁর হাত ধরেই গর্জন তুলেছে বাংলার আঙিনায়। মজা করে বলা হত, মানবেন্দ্র বাড়িতে নতুন নতুন নাম ভাবেন, তাঁদের কাল্পনিক বই বাংলায় ছেড়ে দেন, তার পর তাঁরাই নোবেল পেয়ে থাকেন। বুদ্ধদেব বসুর ছাত্র, লেখাপড়া প্রেসিডেন্সি, যাদবপুর, টরন্টো, ওয়ারশ’ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভৈকম মুহম্মদ বশিরের গল্প তরজমায় পেয়েছেন অনুবাদে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। এ ছাড়াও বিদ্যাসাগর পুরস্কার, অন্নদাশঙ্কর সম্মান। পারদর্শী শিশুসাহিত্যেও। ক্রিকেট প্রিয় বিষয়, লিখেছেন ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসও। যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্য পড়িয়েছেন ষাটের দশকের শেষ থেকে। সম্পাদনা করেছেন বহু গ্রন্থ। সুপণ্ডিত, সুরসিক, মিশুকে মানুষটি চলে গেলেন ৪ অগস্ট।
শ্রদ্ধার্ঘ্য
জন্মেছিলেন অবিভক্ত বঙ্গের কলকাতায়, ১৯৩৭-এ। গত ১৪ মে চলে গেলেন আনিসুজ্জামান, বাঙালির আত্মপরিচয় লাভের জন্যে গত শতকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি ছিলেন এক অগ্রণী সৈনিক। চিন্তাবিদ-শিক্ষক মানুষটি বার বার বলতেন সাংস্কৃতিক বহুত্বের কথা, সাবধান করতেন ‘এক ধর্মসম্প্রদায় যেন অন্য ধর্মসম্প্রদায়ের ওপর প্রাধান্য বিস্তার না করে।’ তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সম্প্রতি প্রকাশ পেল হরপ্পা পত্রিকার (সম্পা: সৈকত মুখোপাধ্যায়) বৈদ্যুতিন পুস্তিকা। লিখেছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, মিহির সেনগুপ্ত, গোলাম মুস্তাফা, ভূঁইয়া ইকবাল, আহমদ কবির, মহীবুল আজিজ, আখতার হোসেন খান, আহমাদ মাযহার। ‘নির্ভীক সমাজ-বিবেক’ হিসেবে তাঁর অতুলনীয় ভূমিকার কথা লিখেছেন গোলাম মুরশিদ, লেখাটির নাম আমার শিক্ষক আনিসুজ্জামান। সোমনাথ ঘোষের প্রচ্ছদ অলঙ্করণ, শিল্প নির্দেশনা চমৎকার।
কলকাতার হ্যারি
৩১ জুলাই হ্যারি পটারের জন্মদিন, জে কে রোওলিং-এরও। এ বারের আয়োজনে বাদ সাধতে চেয়েছিল দুষ্টু জাদুকর করোনা। কিন্তু হেরে গেল সে, ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে গেল আন্তর্জালে। হ্যারির ৪০তম জন্মদিন উপলক্ষে কলকাতার অক্সফোর্ড বুকস্টোর আয়োজন করেছিল সপ্তাহব্যাপী ‘ওয়ান্ডস অ্যান্ড চার্মস ফেস্টিভ্যাল’। ফেসবুকেই হল আলোচনা, বিতর্ক, কর্মশালা ও প্রতিযোগিতা। নামকরণে মিশে ছিল হগওয়ার্টস। ছিল ‘ডিফেন্স এগেনস্ট ডার্ক আর্টস’, ‘স্পেলস অ্যান্ড পোশনস’ ক্লাস। জাদুবিদ্যার ইতিহাসের আলোচনায় জানা গেল গ্রিন্ডেলওয়াল্ড, ডাম্বলডোর, নিউট স্ক্যামান্ডারদের সম্পর্কে অজানা কথা। কচি মনের কেউ সিরিজ়ের চরিত্রদের নিয়ে নতুন গল্প লিখল, কেউ আঁকল নতুন হাঁসজারু পোষ্য। ছিল ‘কুইডিচ কাপ’-এর ফাইনাল, বিতর্কের বিষয়: রোওলিংয়ের রাজনৈতিক সত্তা কি পটার-বিশ্বকে প্রভাবিত করছে? ভোজের আয়োজন হয়েছিল বুকস্টোরের ‘চা-বার’-এ। ছিল প্রফেসর স্প্রাউটস স্যান্ডউইচ, স্নেপস অলওয়েজ়, লুনা লাভগুড’স ইনফিউশন-এর মতো আশ্চর্য খাবার বাড়িতে আনানোর সুযোগও।
হীরক জয়ন্তী
১৯৬০ সালে যাত্রারম্ভ, ষাট পূর্ণ হল রামকৃষ্ণ মিশন আবাসিক মহাবিদ্যালয় নরেন্দ্রপুরের। উত্তর কলকাতার পাথুরিয়াঘাটায় শুরু, স্বামী লোকেশ্বরানন্দের অক্লান্ত শ্রম ও চেষ্টায় কলকাতার দক্ষিণ শহরতলিতে আশ্রম, বিদ্যালয়, ব্লাইন্ড বয়েজ় অ্যাকাডেমি ও মহাবিদ্যালয়ের সূচনা, ক্রমে বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি। বর্তমানে স্বশাসিত এই আবাসিক কলেজের মুকুটে অনেক পালক— ‘পোটেনশিয়াল ফর এক্সেলেন্স’ সম্মান, ‘ডিপার্টমেন্ট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’ ও ‘ফান্ড ফর ইমপ্রুভমেন্ট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ শংসা, কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ মন্ত্রকের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউশনাল র্যাংকিং ফ্রেমওয়র্ক-২০২০ (এনআইআরএফ) তালিকায় স্থান ইত্যাদি। ৩ অগস্ট এক অনলাইন অনুষ্ঠানে প্রাক্তন ও বর্তমান অধ্যক্ষ, ছাত্র ও শিক্ষকদের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণে হয়ে গেল বছরব্যাপী হীরক জয়ন্তী উদ্যাপন অনুষ্ঠানের উদ্বোধন। কলেজের বিভিন্ন বিভাগ এই উপলক্ষে আয়োজন করছে ওয়েবিনার। সংস্কৃত বিভাগের ওয়েবিনার ‘সংস্কৃতকাব্যালোক’ হয়ে গিয়েছে আগেই, ১৪ অগস্ট দুপুর ৩টেয় বাংলা বিভাগের আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারের বিষয় ‘বাংলা সমাজ-সাহিত্যে জনজাতি ও পিছড়ে-বর্গ’। থাকবেন সেলিনা হোসেন, নলিনী বেরা, মেরুনা মুর্মু, অনির্বাণ সাহু।
কর্মোদ্যোগী
স্বাধীনতার বছরে তাঁর বাবা তৈরি করেছিলেন নিজস্ব বাণিজ্য সংস্থা। বর্ধমানের প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নেওয়া, অনুচ্চকিত চর্যায় বেড়ে-ওঠা কৃষ্ণদাস পাল (১৯৪০-২০২০) কেবল পিতার ব্যবসায়িক উত্তরাধিকারই পাননি, অর্জন করেছিলেন দূরদৃষ্টি ও সৎ সাহস। ১৯৭৪-এ নিজের পরিবেশনা সংস্থা, আর নিজস্ব ব্র্যান্ড ‘বিস্ক ফার্ম’-এর শুরু ২০০০ সালে, যখন তিনি ষাট। যে বয়স অবসরের, সেই বয়সেই নবনির্মাণের যাত্রারম্ভ এই উদ্যোগপতির। পথ অবাধ ছিল না, ছিল প্রতিযোগিতা, প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ও ব্র্যান্ডের চ্যালেঞ্জ। সব সামলে, তাঁর দেখানো পথে পূর্ব ভারতে আজ দ্বিতীয় বৃহত্তম মার্কেট শেয়ার তাঁর সংস্থার। পঁচাত্তর-ছোঁয়া জন্মদিনের বার্তায় লিখেছিলেন, শুধু ব্যবসায়ী বা শিল্পপতিরই নয়, মানুষ মাত্রেরই ব্যক্তিগত, পেশাগত ও সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকা জরুরি। বিশ্বাস করতেন, সংস্থার নিয়ামক ও কর্মীদের অকপট সংযোগ, স্বচ্ছ বোঝাপড়াই শিখরে পৌঁছে দিতে পারে প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে, যার উত্তরসূরি পুত্র অর্পণ পাল। বাণিজ্যে ‘সেরা বাঙালি’র আনন্দ সম্মান পেয়েছিলেন ২০১৭-তে, আশি বছর বয়সে চলে গেলেন এই উদ্যমী বাঙালি উদ্যোগপতি।
প্রবাদপ্রতিম
ইংরেজি সাহিত্যে প্রগাঢ় প্রজ্ঞা অসমের সীমানা পেরিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধার্হ করেছিল বাংলা-সহ সারা দেশে। ডিব্রুগড়ের বাড়িতে গত ৬ অগস্ট চলে গেলেন গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমেরিটাস অমরেশ দত্ত। লখনউ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ ডি, পঞ্চাশের দশকে যোগ দেন মধ্যপ্রদেশের তৎকালীন সাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। দীর্ঘ কাল পড়িয়েছেন গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, আশির দশকে সেখানকার ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর ও প্রধান হিসেবেই অবসর নেন। ছিলেন ডিব্রুগড় বিশ্ববিদ্যালয়েও। দিল্লিতে সাহিত্য অকাদেমির এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইন্ডিয়ান লিটারেচার প্রকল্পেও যুক্ত ছিলেন। শেক্সপিয়র-চর্চায় তাঁর অবদান অসীম, তাঁর লেখা শেক্সপিয়র্স ট্র্যাজিক ভিশন (১৯৬৩) বইয়ে মুগ্ধ ছিলেন জর্জ উইলসন নাইট, ই এম ডব্লিউ টিলইয়ার্ড-এর মতো তাবড় সাহিত্য সমালোচক। পঞ্চাশের দশকে তাঁর কবিতাবই রোমে আন্তর্জাতিক কবিতা সংস্থার পুরস্কার পেয়েছিল। শিলচরের অসম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডক্টরেট, পেয়েছিলেন অসমের সংস্কৃত বিশারদ পদ্মভূষণ কৃষ্ণকান্ত হান্ডিকের নামাঙ্কিত জাতীয় পুরস্কারও। কয়েক প্রজন্মের ছাত্রদের প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক চলে গেলেন ১০২ ছুঁই-ছুঁই বয়সে।
সিনেমা নিয়ে
জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলা ছবি এখন শিল্পমান বা ইন্ডাস্ট্রির লাভালাভের দিক থেকে কোথায় দাঁড়িয়ে, তা নিয়ে অনলাইন ওয়েবিনারে প্রেমেন্দ্র মজুমদারের পরিচালনায় বললেন অতনু ঘোষ, ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী, ফিরদৌসুল হাসান, শুভজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও শতরূপা সান্যাল। উদ্যোক্তা পঞ্চাশটি দেশের চলচ্চিত্র সমালোচকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘ফিপরেস্কি’। এর আগেও আলোচনা হয়েছে কেরল ও উত্তর-পূর্ব ভারতের চলচ্চিত্র নিয়ে, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ় অব ইন্ডিয়া-র সঙ্গে যুগ্মভাবে হয়েছে কন্নড় চলচ্চিত্রকার গিরিশ কাসারাভাল্লির ছবির রেট্রো ও তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতাও। ফিপরেস্কি-র ইউটিউব চ্যানেলে আলোচনাগুলি দেখতে ও শুনতে পারবেন সকলেই। এ মাসে তাদের উদ্যোগের মধ্যে আছে আজ থেকে ১৬ অগস্ট অপর্ণা সেনের ছবির রেট্রো, ১৩ অগস্ট সন্ধে ছ’টায় তাঁর সাক্ষাৎকার। অন্য দিকে ১৬-৩১ জুলাই হয়ে গেল ইমামি আর্ট অনলাইন ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, সেখানে ছিল কলকাতার সুপ্রিয় সেন থেকে মণিপুরের হাওবাম পবন কুমারের ছবি। শেষ দিন আলোচনা হল এ দেশে তথ্যচিত্র ও পরিবেশের ভারসাম্য নিয়ে।
গান-আলাপ
শিষ্যের আধার বুঝে তালিমের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করেন গুরু। শিষ্যের গায়কিতে গুরুর ঘরানার উত্তরাধিকার বেঁচে থাকে, লালিত হয় তার নিজস্ব ধারাও। এ ভাবেই গুরু-শিষ্য পরম্পরায় ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের ঘরানা ঋদ্ধ হয়েছে, জানালেন পদ্মশ্রী শুভা মুদ্গল। হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের নক্ষত্রের সঙ্গে গান-আলাপে ছিলেন বাংলার শাস্ত্রীয় ও সমসাময়িক সঙ্গীতধারার অগ্রণী প্রতিনিধি কৌশিকী চক্রবর্তী। ইস্টার্ন জ়োনাল কালচারাল সেন্টার ও প্রভা খৈতান ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে ডিজিটাল অনুষ্ঠান ‘সুর অউর সাজ়’-এ উঠে এল নানা কথা। শুভা স্মরণ করলেন তাঁর সঙ্গীতগুরু রামাশ্রেয় ঝা, বিনয়চন্দ্র মৌদ্গল্য, কুমার গন্ধর্ব প্রমুখকে। সঙ্গীতদুনিয়ায় স্বজনপোষণ তাঁর মতে লক্ষ্যভ্রষ্ট তির, অভিমান ফুটল বলিউড প্রসঙ্গেও— তাঁর কণ্ঠকে যোগ্য স্থান দিতে ব্যর্থ তারা। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের কাঠামোতেও ঠিক তৈরি হবে সুরপ্রতিমা, মত শুভার। কৌশিকী মনে করালেন রাগসঙ্গীত সম্মিলনী ‘বাজাগাজা’-য় শুভার সঙ্গে কাটানো সোনালি দিনের কথা।
এগিয়ে চলা
এ বছর পঁচিশে বৈশাখে অষ্টাশিতে পা দিলেন তিনি। এখনও সতেজ সক্রিয়, মূকাভিনয়ের নামে চিরচাঙ্গা যোগেশ দত্ত। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ‘পদাবলী’র পঞ্চাশ পূর্তিতে মূকাভিনয়, গান ও অভিনয়-সহ নানা কর্মসূচি পালনের পরিকল্পনা ছিল যোগেশ মাইম অ্যাকাডেমির। বাদ সেধেছে করোনা, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম দমে যায়নি। যোগেশ মাইম অ্যাকাডেমির ফেসবুক পেজে শুরু হয়েছে উদ্যাপন— প্রতি শনি ও রবিবার মূকাভিনয়, নাটক ও সঙ্গীতের ক্লাস। নিয়ম করে প্রতিদিন প্রথম ক্লাসটা নিচ্ছেন যোগেশ দত্ত নিজে। ‘ফেশিয়াল এক্সপ্রেশন’ শেখাচ্ছেন, স্মৃতিচারণের আঙ্গিকে জানাচ্ছেন ভারতীয় মূকাভিনয়ের ইতিহাসও। নতুন প্রজন্ম উদ্দীপ্ত, অসম থেকে প্যারিসে ছড়িয়ে থাকা যোগেশবাবুর পুরনো ছাত্রছাত্রীরাও যোগ দিচ্ছেন নিয়মিত। ‘‘আমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বহু মূকাভিনয় শিল্পী, যেমন এ মাসেই ক্লাস করাবেন কোস্টারিকার বিখ্যাত মূকাভিনয় শিল্পী ফেডেরিক হারেরা,’’ জানালেন সংস্থার সম্পাদক প্রকৃতি দত্ত। বাচন ও শ্রবণ-প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে বেশ কিছু ক্লাসের পরিকল্পনা হয়েছে। নানান শিল্প-পরিসরের বর্ষীয়ান শিল্পীদের আলোচনা ও স্মৃতিচারণ তথ্যচিত্রের আকারে ধরে রাখার মূল্যবান কাজটিও চলছে সমান্তরালে। ছবিতে চার্লি চ্যাপলিন পরিবার-এর অভিনয়দৃশ্যে যোগেশ দত্ত ও সহশিল্পীরা।
ছক-ভাঙা
“আমি লেখার ব্যাপারটা যেভাবে বুঝি সেটা নিছক আনন্দ দেওয়া বা নেওয়া নয়। আরও গভীর এক অ্যালকেমি যেখানে বিস্ফোরণের ঝুঁকি রয়েছে।” নতুন সহস্রাব্দের গোড়ায় এ কথা বলেছিলেন নবারুণ ভট্টাচার্য। প্রতি বছর ৩১ জুলাই মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর তৈরি ‘ভাষাবন্ধন’ পত্রিকা ও পরিবারের তরফ থেকে একটি স্মারক বক্তৃতা ও আলোচনাসভার আয়োজন করা হত, এ বছর তা সম্ভব হয়নি। পরিবর্তে সে দিন ‘ভাষাবন্ধন’-এর ফেসবুক পেজে হল ই-অনুষ্ঠান। উদ্বোধন হল ভাষাবন্ধন ওয়েবসাইটেরও। সেখানে পত্রিকার নানা সংখ্যা পড়া যাবে, কেনা যাবে প্রকাশিত বই। নবারুণের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীতে সে দিন ‘দৃশ্য’ সংস্থাও নবারুণ-স্মরণের আয়োজন করে। ছিলেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, সুমন মুখোপাধ্যায়, অভীক মজুমদার ও তথাগত ভট্টাচার্য। বাংলা সাহিত্যের ছক-ভাঙা মানুষটিকে শ্রদ্ধা জানাল ‘পরম্পরা’ পত্রিকাও।
আচার্য
তিনি লিয়েন্ডার পেজের ‘স্রষ্টা’। ভারতীয় টেনিস দলের নন-প্লেয়িং ক্যাপ্টেন থাকার সময় অনেকের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বেকবাগান রোয়ের ষোলো বছরের কিশোরকে দলে নেওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন। ১৯৯০ সালে সেই ছিল শুরু, পরে ভারতীয় টেনিসের অর্জুন হয়ে ওঠেন লিয়েন্ডার পেজ। ৯১ বছর বয়সে এ বার ‘দ্রোণাচার্য’ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন গুরু— কলকাতার টেনিস কিংবদন্তি নরেশ কুমার। সাউথ ক্লাবের ঘাসের কোর্ট থেকে যাঁর উইম্বলডনের সবুজে যাত্রা বাংলার ক্রীড়া-ইতিহাসে অন্যতম সেরা রূপকথা। ১৯৫৫ সালে উইম্বলডন সিঙ্গলসের চতুর্থ রাউন্ডে পৌঁছেছিলেন। সে বছরই ডাবলস কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠেন রমানাথন কৃষ্ণনের সঙ্গে জুটি বেঁধে। ১৭টি ডেভিস কাপ ম্যাচ খেলেছেন। এর পরে সাফল্যের সঙ্গে নন-প্লেয়িং ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব সামলে তিনিই হয়ে উঠলেন ‘নরেশ স্যর’। যদি পুরস্কৃত হন, এই প্রথম টেনিসের দুনিয়া থেকে কেউ দ্রোণাচার্য পুরস্কারে সম্মানিত হবেন। পরিপাটি পোশাকের রুচি, শিল্পকলার দিকে ঝোঁক, উইম্বলডন নিয়ে দারুণ সব বিশ্লেষণমূলক লেখা— টেনিস কোর্টের বাইরেও নরেশ কুমার অন্য রকম।
ঝুলনযাত্রা
পুরনো কলকাতায় আলাদা গুরুত্ব ছিল ঝুলনের। ঝুলন ঘিরে চলত নাচগান, যাত্রা, কীর্তন ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর, তৈরি হত সামাজিক মেলামেশার পরিসর। বৌবাজার এলাকার কিছু বাড়িতে ঝুলন উপলক্ষে আসতেন ভারতের নামকরা সঙ্গীত বিশারদরা, গান শোনার সুযোগ পেতেন সাধারণ মানুষ। সেই পরম্পরা গত বছর পর্যন্তও চলেছে বৌবাজারের ‘ঝুলন বাড়ি’ নামে খ্যাত অধিকারী-বাড়ির মতো কিছু পরিবারে। আছে ভোগ নিবেদন, পুতুল দিয়ে কৃষ্ণলীলা সাজানো, নানা দিনে বিগ্রহের নানা সাজ— রাখাল বেশ, যোগী বেশ, সুবল বেশ, রাজ বেশের প্রথা। করোনা-আবহে এ বছর শুধু দৈনিক পূজার্চনা, ঠাকুরের বেশ বদল হয়েছে। ‘চাঁদ-সূর্য বাড়ি’ নামে খ্যাত শ্রীমন্ত ভিলার ঝুলনে দেশীয় বিদ্যুৎচালিত প্রযুক্তিতে সূর্যের উদয়-অস্ত, রাতের আকাশে চাঁদ-তারার খেলা বন্ধ, পরিবারের পক্ষে জানালেন সৌম্যশ্রী পণ্ডিত। নিয়ম মেনে ঝুলন হয়েছে ক্রাউচ লেনের দয়াল দাসের ঠাকুরবাড়িতে, মানিকতলা বিনোদ সাহা লেন সংলগ্ন মণ্ডলদের মন্দিরে ঝুলন হলেও মেলা হয়নি। ভাঙা হাটে অন্য রকম খবর গোকুল বড়াল স্ট্রিটের প্রামাণিক বাড়িতে। সাড়ম্বর ঝুলনের জন্য একদা-বিখ্যাত এই পরিবারে পরে বন্ধ হয়ে যায় অনুষ্ঠান, বিগ্রহও দান করে দেওয়া হয় এক মন্দিরে। রাধাকৃষ্ণের নতুন যুগল বিগ্রহ গড়ে এ বছরই নতুন করে শুরু হয়েছে এই বাড়ির ঝুলন (ছবিতে ত্রিশূলধারী কৃষ্ণের যোগী বেশ), জানালেন এই প্রজন্মের সন্দীপ প্রামাণিক। মারি-আবহে এ ভাবেও ফিরে আসা যায়!
গ্রহের গ্রহণ
সমস্ত আণবিক অস্ত্র, যুদ্ধাস্ত্র— ফেলে দিতে হবে। এ সবের জন্যেই গ্রহকুলে পৃথিবী আজ একা, ক্রমশ ঘনীভূত তার সঙ্কট... প্রফেসর শঙ্কু সতর্ক করতে থাকেন মহাকাশের অন্য কোনও গ্রহ থেকে, প্ল্যানেট ফেডারেশনের তরফ থেকে। বলেন, তৈরি করতে হবে ভালবাসার বোমা, যা ঘৃণা, স্বার্থপরতা ধ্বংস করবে। লকডাউনে তাদের নতুন নাটক গ্রহের গ্রহণ পেশ করল ‘শূদ্রক’ নাট্যগোষ্ঠী— ইউটিউবে। এখনও সেখানেই দেখতে পাবেন দর্শক। বিষয় সিরিয়াস হলেও হিউমার ও শ্লেষের ভিতর দিয়ে মঞ্চভাষার শর্ত মেনে এগোয় এই নাটক। রচয়িতা ও নির্দেশক দেবাশিস মজুমদার জানালেন, ‘‘দক্ষ শিল্পীর হাতে পড়লে ই-নাটক হতেই পারে থিয়েটারের নবীন-চারণ।’’ নাটকের শেষে সজীব চারাগাছ হাতে নিয়ে শঙ্কু ইচ্ছা প্রকাশ করেন সত্যজিতের শতবর্ষে কলকাতায় আসার।
চেতলা-চরিত
‘চাল চিড়ে ঝ্যাৎলা/ তিন নিয়ে চেতলা।’ অনেক প্রচলিত বয়ানের মধ্যে থেকে ‘চেতলা’ নামের ব্যুৎপত্তি হিসেবে এই ছড়াই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে লেখকের। আদিগঙ্গার পাড়ে প্রাচীন এই অঞ্চলে পাওয়া যেত বালাম চাল, উৎকৃষ্ট চিঁড়ে। ‘ঝ্যাৎলা’ হল মাদুর বোনার কাঠি, তা দিয়ে মাছ রাখার বাক্সও তৈরি হত। চেতলা ছিল মাছ ব্যবসার বড় কেন্দ্র। চেতলার পুরনো বাসিন্দা সুব্রতকুমার ব্রহ্ম তাঁর বই চেতলা: স্মৃতি বিস্মৃতির অন্তরালে (প্রকাশক লেখক নিজেই) লিখেছেন দীর্ঘ দিন ধরে আহরিত তথ্যের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ও পরম মমতার মিশেলে। রয়েছে প্রাচীন চেতলার পুজোপার্বণ, বনেদি বাড়ি, স্বাধীনতার আগে-পরে চেতলার অবস্থান, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য পরিষেবা, স্কুল, সিনেমাহলের ইতিহাস। পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার লেখকের আঁকা চেতলার পুরনো বিলুপ্ত ভবন, ঘাট, বাজারের স্কেচ এই বইয়ের মূল্যবান সংযোজন।
পড়েছে মনে
লকডাউনের আগের সন্ধেয় কলকাতা জলদি ঘরমুখী। অফিস-ফেরত বাবু হন্তদন্ত, দুধের প্যাকেট পাওয়া চাই, পাউরুটি নেওয়া হয়নি সকালে। ঘড়ির কাঁটা রাত আটটা না ছুঁতেই চা-দোকানে অন্তিম কেটলির হিসহিস। এই সব নাগরিক শব্দের ওঠাপড়া, মিলিয়ে-যাওয়ার মাঝেই জেগে থাকে তাঁর কণ্ঠ, অবিনশ্বর সুর। উত্তমকুমারের লিপে শর্মিলার শাড়ির ভাঁজে চোরকাঁটা হওয়ার প্রগল্ভ ইচ্ছে ছড়াচ্ছেন, সৌমিত্রর পিয়ানোয় গলা খুলছেন ‘বৌঠাকুরাণী’ মাধবীর জন্য, উদাত্ত সুরের গুরুদক্ষিণা দিচ্ছেন ছলছল তাপস পাল হয়ে। তখন অবিরল খাবার পৌঁছে দেওয়া তরুণটির ক্লান্ত বাইকের চাকাতেও হঠাৎ-গতি, কোত্থেকে ভেসে আসছে ‘ম্যায় হু ডন...’ ‘আনেওয়ালা পল’-এর শেষ সুরবিন্দুটুকু শুনে শাটার নামাচ্ছে ওষুধ-দোকানি। করোনার কলকাতা বিলক্ষণ বেসুরো, তবু তার মাঝে একটি শ্রাবণদিন, একটা ৪ অগস্ট সুরময়। কিশোরকুমারের জন্মদিন যে!
এই শহরের সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান
বিড়লা অ্যাকাডেমিতে অগুস্ত রোদ্যাঁ-র ভাস্কর্যের প্রদর্শনী। ১৯৮৩। প্রবল বৃষ্টি মাথাতেও প্রতীক্ষারত মানুষ। টেলিভিশনে তা নিয়ে অনুষ্ঠান হবে না, হয়? একটা হিতাচি কালার ক্যামেরা জুটে গেল, কিন্তু মুশকিল— কলকাতা দূরদর্শনে সাদা-কালো টেপ, সিগন্যালও তাই। ঠিক হল, এক্সপেরিমেন্ট হবে। সাদা-কালোর জায়গায় কালার সিগন্যাল দিলে রঙিন ক্যামেরায় কি রেকর্ড হবে না? হল। সেটাই কলকাতা দূরদর্শনের প্রথম রঙিন অনুষ্ঠান। প্রথম কালার ট্রান্সমিশনও ওই ’৮৩-তেই।
গতকাল জন্মদিন ছিল কলকাতা দূরদর্শনের। ১৯৭৫ থেকে ২০২০, ৪৫ বছরের যাত্রায় তার মুকুটে হরেক পালক, কিন্তু শুরুর দিনগুলোয় হোঁচট কম ছিল না। পূর্ব ভারতে টেলিভিশন প্রথম এল কলকাতায়। আগে সীমাবদ্ধ ছিল দিল্লিতে। পড়শি বাংলাদেশে টিভি এসেছে আগেই। এমন বলা হত, এ দেশ সাইকেলের দেশ, গাড়ির নয়; রেডিয়োর দেশ, টিভি এখানে চলবে না। শুরুর সময় টেলিভিশন ছিল আকাশবাণী তথা অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো-র অধীনে। তখন ‘দূরদর্শন’ নয়, ‘কলকাতা টেলিভিশন কেন্দ্র’। কলকাতায় টেলিভিশনের প্রথম কর্মী, পরবর্তী কালে অধিকর্তা পঙ্কজ সাহা স্মৃতিতে ফিরছিলেন, ‘‘অপেক্ষা আর উৎকণ্ঠায় ভরা সেই দিনগুলোয় কলকাতায় টেলিভিশন আনতে সহায়ক হয়েছিল রাজনীতিও। রাজ্যের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বিরাট ভূমিকা ছিল।’’
গল্ফ গ্রিনের দূরদর্শন ভবন তো এল পরে (ছবিতে সেখানকার এডিটিং রুম)। শুরুর দিনগুলোয় রাধা ফিল্ম স্টুডিয়োয় নামমাত্র পরিকাঠামো, তার মধ্যেই অনুষ্ঠান রেকর্ড করে ক্যানবন্দি করা। ৯ অগস্ট উদ্বোধনের পরের দিনই প্রবল ঝড়বৃষ্টি, সম্প্রচার হল না। কর্মীদের কারিগরি জ্ঞান সীমিত, অনুষ্ঠানের মডেলও যে জানা তা-ও নয়। শুরু থেকেই কলকাতা দূরদর্শন স্বশিক্ষিত। সে গড়েপিটে নিয়েছিল নিজের ভাষা, নিজস্ব আঙ্গিক। তাকে কাঁধ দিয়েছে কলকাতার সারস্বত বৃত্ত। তার ‘দূরদর্শন’ নামে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সিলমোহর, ‘সংযোজনা’ শব্দে শঙ্খ ঘোষের সমর্থন। রোজ সন্ধেয় মোটে দু’ঘণ্টার অনুষ্ঠান, কিন্তু এই শহর খুব তাড়াতাড়ি আপন করে নিয়েছিল কলকাতা দূরদর্শনকে। কত অনুষ্ঠান— ‘দর্শকের দরবারে’, ‘সাহিত্য সংস্কৃতি’, ‘বিজ্ঞান জিজ্ঞাসা’, ‘কোয়েস্ট’, ‘সুস্বাস্থ্য’, ‘শিল্পজগৎ’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘একটু ভেবে দেখুন’, ‘চিচিং ফাঁক’, ‘হরেকরকমবা’। শুরু থেকেই জোর ছিল বিজ্ঞানমনস্কতায়। খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ‘নববর্ষের বৈঠক’ আর বাংলা ছবি। আজ জনতার মাঝে বা নিয়ন্ত্রিত আউটডোরে টিভি-অনুষ্ঠান দেখে মনে হয় এ তো খুব স্বাভাবিক, এই সবই কলকাতা দূরদর্শনের শুরু।
লেখক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, খেলোয়াড়— জীবনের সব ক্ষেত্রে লব্ধপ্রতিষ্ঠ মানুষের যোগসূত্রে মানুষের আস্থা সঙ্গে ছিল কলকাতা দূরদর্শনের। দীর্ঘ দিন সে-ই ছিল মহানগরের দৃশ্য-শ্রাব্য সংস্কৃতির অভিজ্ঞান। ’৭৭-এর নির্বাচন, ’৭৮-এর বন্যা, ’৮২-র এশিয়াড-সহ একের পর এক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংঘটনকে ঘরে ঘরে পৌঁছনোর যাত্রায় সে দর্শকরুচিকে বৈশ্বিক করেছে, বেড়ে উঠেছে নিজেও। ‘একক’ থেকে আজ তবু সে নিতান্ত ‘অন্যতম’, এটাই যুগসত্য। সেই বেড়ে ওঠার দিন ফুরোল তবে?