উনিশ শতকের মাঝামাঝি দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু ছিলেন হাওয়ার্ড স্টনটন। তাঁর প্রস্তুতিতে সাহায্য করেছিলেন স্কটিশ সাহেব জন কোকরান, জীবনের একটা অংশ যিনি কাটিয়েছিলেন কলকাতায়। এখানে তাঁর দাবার জুড়ি ছিলেন মহেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৮৪৮-১৮৬০ সময়কালে কোকরান ও মহেশচন্দ্রের বেশ ক’টি খেলার বর্ণনা ছাপা হয় উনিশ শতকে দাবার আন্তর্জাতিক পত্রিকা চেস প্লেয়ার্স ক্রনিকল-এ। আন্দাজ মেলে কলকাতার দাবাড়ুদের মানেরও।
আজ মাল্টি-লোকেশন মাল্টি-প্লেয়ার ইন্টারনেট গেমিং-এর প্রথায় অভ্যস্ত আমাদের ভাবতেও অবাক লাগে, সেই ১৮৮০ সালে দাবা খেলার আয়োজন হয়েছিল কলকাতা আর লিভারপুলের মধ্যে! বিশেষ টেলিগ্রাফিক কোড ব্যবহার করে চাল দিয়েছিলেন লিভারপুর চেস ক্লাব দল এবং কলকাতার খেলোয়াড়রা। অক্টোবর থেকে পরের মার্চ পর্যন্ত চলা দু’টি গেমের প্রথমটি জেতে লিভারপুল, দ্বিতীয়টি ড্র হয়। সেই সময় সাড়া ফেলে দেওয়া এই খেলার মূল আয়োজক ও কলকাতার দলের নেতা ছিলেন নামী ব্যবসায়ী রবার্ট স্টিল। তাঁর সহযোগী খেলোয়াড়দের নাম জানা যায় না, তবে দলে একাধিক এদেশীয় খেলোয়াড়ের উপস্থিতির প্রমাণ ম্যাচ রিপোর্টে ‘বাবু’ শ্রেণির খেলোয়াড়দের উল্লেখ।
তবে ১৮৮০-রই এক রিপোর্টে বাবু ঈশ্বরচন্দ্র গোসাঁই ও মহাদেব চৌবের নাম পাওয়া যায় দেশের নামী দাবাড়ু হিসেবে। ১৮৭৮-এ কলকাতার প্রথম রাউন্ড-রবিন দাবা প্রতিযোগিতায় যুগ্ম বিজয়ী হন স্টিল ও গোসাঁই। ক্রিকেট-ফুটবলে যখন জাতি বর্ণ ধর্মের ভেদ, তখন দাবায় সাহেব ও ভারতীয় খেলোয়াড়দের সমান অংশগ্রহণ ঘটনা বইকি! শোভাবাজার দেববাড়ি, পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়ি ও ঘোষবাড়ি-সহ ধনীদের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতায় তখন বহু দক্ষ দাবাড়ু। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, অধিকাংশ জায়গাতেই স্বনামে নয়, স্রেফ ‘ব্রাহ্মণ’ বা ‘নেটিভ’ হিসেবেই উল্লিখিত হয়েছে মহেশচন্দ্র-সহ শ্যামাচরণ ঘটক, রামমোহন চক্রবর্তী, পীতাম্বর মুখোপাধ্যায়দের নাম।
উনিশ শতকীয় বাবুদের দিন পেরিয়ে, বিশ ও একুশ শতকে শহরে দাবার চর্চা পোক্ত হয়েছে। নানা চেস ক্লাব, বিকল্প পরিসর গড়িয়াহাট মোড়ের দাবার আড্ডা। ২০১৮-তে কলকাতা পুলিশের সামাজিক কাজের আওতায় নবসজ্জিত এই দাবা-ঠেক শহরের বিশিষ্টতা। দাবার সঙ্গে সুদীর্ঘ যোগ কলকাতা পুলিশ-এর, ১৮৯৯-এ হেনরি হ্যারিসন পুলিশ কমিশনার থাকাকালীন যার শুরু। দাবায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, গ্র্যান্ডমাস্টার, ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার পেয়েছে ভারত, দাবা নিয়ে উৎসাহে পিছিয়ে নেই কলকাতাও। আক্ষেপ একটাই, দাবার সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের কথা ভুলেছে শহর। আসছে ২০ জুলাই, আন্তর্জাতিক দাবা দিবস-এর আবহে শহরের সেই অগ্রদূতদের স্মরণ ইতিকর্তব্য নয় কি? ছবিতে ২০১৭ সালে সালকিয়া বাবুডাঙায় পুজোদালানে দুই মগ্ন দাবাড়ু।
অন্তরে যিনি
১১ জুলাই জন্মদিন চলে গেল অধ্যাপক রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্তের (১৯১৫-২০০৯) (ছবিতে)। বাংলা, বিশ্ব তাঁকে চেনে অতুল পাণ্ডিত্যের জন্য, আর ঘনিষ্ঠেরা জানতেন বৈদগ্ধের ও-পারে বিবেক ও হৃদয়কে কত গুরুত্ব দিতেন তিনি। সে কথাই বলছিলেন সর্বানন্দ চৌধুরী, গত ১১ জুলাই বিকেলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দারভাঙা হল-এর সভায় উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের সামনে: নবম রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত স্মারক বক্তৃতায়, বিষয় ‘হৃৎকমলের গান: প্রসাদী, বাউল ও ব্রহ্মসঙ্গীত’। আঠেরো-উনিশ শতকে এই তিন ধারার গানেই মানুষের অন্তর-অন্বেষায় কী করে তৈরি হচ্ছিল জ্ঞানচর্চার এক বিকল্প বয়ান, বোঝালেন সঙ্গীতবেত্তা বক্তা। রাজশ্রী ভট্টাচার্যের গানে, চিন্ময় গুহের নান্দীমুখে পূর্ণ হল এক সারস্বতের স্মরণ— কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও রবীন্দ্র-পরিবারের উদ্যোগে ও আনুকূল্যে।
কীর্তনের সুরে
লোকগীতি নিয়ে কয়েক দশকের ঘরবসতি। উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া নিয়ে গবেষণায় পিএইচডি, ডি লিট তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার অভিজ্ঞান, অন্য দিকে আকাশবাণীর লোকগীতির সর্বোচ্চ গ্রেডের গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা সুখবিলাস বর্মার। কোচবিহারের গ্রাম কৃষ্ণপুরে বৈষ্ণব বাবার কাছে কৈশোরে কীর্তন ও খোলবাদ্য শিখেছেন; গ্রামের সান্ধ্য কীর্তন ও ভাওয়াইয়ার আসরে, মাঠেঘাটে ভাওয়াইয়া চটকা কুষাণ বিষহরা গানের ধুয়া গেয়ে পেয়েছেন খাঁটি ‘বাহিরানা’র শিক্ষা। আমলাজীবন সামলেও গায়নে অনুষ্ঠানে প্রসারিত করেছেন বাংলার লোকগান, তার বিস্তারকে ধরে রেখেছেন ক্যাসেট ও সিডিতে। এ বার ‘ভাবনা রেকর্ডস’-এর উদ্যোগে তৈরি তাঁর কীর্তনের দু’টি অ্যালবামের আনুষ্ঠানিক প্রকাশ আগামী ২০ জুলাই সন্ধ্যা ৬টায়, রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার গোলপার্কের শিবানন্দ হলে। আশি ছুঁই-ছুঁই শিল্পী গবেষক কীর্তন পরিবেশনও করবেন এ দিন।
কারা-কাহিনি
প্রতি বছর ১৮ জুলাই পালিত হয় নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মদিন, তাঁর নামাঙ্কিত আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে। সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে তাঁর সংগ্রামের অচ্ছেদ্য অংশ ছিল কারাবাস। প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে আজও সমান প্রাসঙ্গিক কারাগার, দুর্বহ তার ভার। ১৮ জুলাইয়ের আবহে আন্দামান-নিকোবর, মায়ানমার, ভিয়েতনাম, তানজানিয়া-সহ এশিয়া ও আফ্রিকার ঐতিহাসিক কয়েকটি কারাগার নিজে ঘুরে দেখার কথা বলবেন অরিন্দম মুখোপাধ্যায়, আগামী সোমবার সন্ধ্যা ৬টায়, আইসিসিআর-এর পঞ্চম তলের সভাকক্ষে; সভামুখ্য চয়ন মুখোপাধ্যায়। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ় (আইএসসিএস বাংলা)-এর উদ্যোগে এই অনুষ্ঠান, ‘কারা কাহিনি’।
চার দশ তিন
আশির দশকে দক্ষিণী-তে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার পাশাপাশি সমান্তরাল সংস্থা খুলে প্রকাশ্যে রবীন্দ্রনাথের গান চর্চার ভাবনাটাই ছিল খুব কঠিন। প্রাক্তনী কিছু অগ্রজের প্রশ্রয়ে সে দিনের প্রায় লুকিয়ে রাখা রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা কেন্দ্র ‘ধৈবত’ তেতাল্লিশ বছরে পা রাখল এ বছর। পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক মানচিত্রে পরিচিত নাম, নানা ভাবনার রবীন্দ্র-গীতিগুচ্ছ নিবেদনে অর্জন করেছে রবীন্দ্রানুরাগীদের আদর। তেতাল্লিশ বছর ধরেই সম্পাদক শেখর চৌধুরীর নিয়মনিষ্ঠ ছায়ায় ধৈবতের অনেকেই আজ পরিচিত প্রতিষ্ঠিত গাইয়ে। প্রথম অনুষ্ঠানের নাম ছিল ‘শ্রাবণ রজনী’, আর আজ ১৬ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শিশির মঞ্চে ধৈবতের বার্ষিক অনুষ্ঠানের শিরোনাম ‘অনেক দূরের মিতা’। একক ও সমবেত রবীন্দ্রগানের পরতে পরতে থাকবে জীবনানন্দ দাশ বিষ্ণু দে মহাদেব সাহা জয় গোস্বামীর বর্ষাগাথার ধরতাই।
সান্নিধ্য
আধুনিক কন্নড় থিয়েটার তাঁর হাতে পেয়েছে নতুন পথদিশা। ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা-র প্রাক্তনী, নাট্যকার ও নাট্য-নির্দেশক প্রসন্নের সঙ্গে কলকাতার সংযোগ আজকের নয়, ১৯৭০-এর দশকে তাঁর ও সমমনস্ক কর্মীদের গড়া দল ‘সমুদয়’-এর সঙ্গে কলকাতার থিয়েটারপাড়ার পরিচয়ও পুরনো, ঘনিষ্ঠ। তাঁর হাতে অভিনয়ের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন রঘুবীর যাদব ইরফান খান সুরেখা সিক্রি বিজয় রাজ থেকে আদিল হুসেন দেবাশিস মণ্ডলরা। শহরের থিয়েটারকর্মীদের জন্য সুংসবাদ, সঙ্গীত নাটক অকাদেমি সম্মানে ভূষিত এই নাট্যনির্দেশক একটি অভিনয়-কর্মশালা করাবেন এ শহরে, কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি (কেসিসি)-র উদ্যোগে, আগামী ১৭-২২ অগস্ট। যোগদানের বিশদ তথ্য কেসিসি-র ওয়েবসাইটে।
নারী ও নিসর্গ
চিত্রশিল্পী রোকেয়া সুলতানার সঙ্গে এই বাংলার সম্পর্ক নিবিড়, গভীর। বিশ্বভারতীর কলাভবনের প্রাক্তনী, শিল্পের পাঠ পেয়েছেন সোমনাথ হোর, লালুপ্রসাদ সাউ, সনৎ করের কাছে। প্রায় তিন দশক শিল্পসৃষ্টিতে মগ্ন, পরিচিত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপচিত্র বিভাগের অধ্যাপক। কাজ করেছেন টেম্পারা, জলরং, তেলরং, মিশ্র মাধ্যমেও। তাঁর ছবিতে নারী, মাতৃত্ব ও নিসর্গ স্বকীয়তায় ভাস্বর, মূল সুরটি শিল্পিত অন্তর্মুখিতা; মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা-প্রাণিত তাঁর চিত্রকৃতি যেন ইতিহাসের সময়ছবি। তাঁর সমগ্র শিল্পজীবনের বাছাই কাজ নিয়ে প্রদর্শনী চলছে আইসিসিআর-এর নন্দলাল বসু ও যামিনী রায় গ্যালারিতে, গত ৭ জুলাই উদ্বোধন করলেন যোগেন চৌধুরী। হল গ্রন্থপ্রকাশও। আইসিসিআর ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত এই প্রদর্শনী চলবে ২০ জুলাই পর্যন্ত, রোজ সকাল ১১টা থেকে রাত ৮টা। ছবিতে দু’টি চিত্রকৃতি, উইমেন অব ওয়ার: ১৯৭১ (বাঁ দিকে) এবং পাউচ অব মাদারস।
বাদল মেলা
শুধু তো নাট্যনির্মাণ ও নির্দেশনা নয়, বাদল সরকার (ছবিতে) মানে এক জীবনবোধ। কান্না, যন্ত্রণা, বিষাদ পেরিয়ে প্রতিবাদ, ক্ষমতার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মানবিক বিস্ফার এবং সর্বোপরি বেঁচে থাকার দর্শন। এই দর্শনেরই অনুসারী নাট্যগোষ্ঠী ‘গোত্রহীন’, বিশ্বাসী মানুষের থিয়েটারে, বিরুদ্ধস্বরের নির্দ্বিধ উচ্চারণে। একই সঙ্গে তাদের মনোযোগ যাতে নাট্যপ্রযোজনাগুলি কম খরচে, অথচ নান্দনিকতার সঙ্গে আপস না করেই করা যায়। আজ ও আগামী কাল, ১৬-১৭ জুলাই তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহে ‘বাদল মেলা’ করতে চলেছে গোত্রহীন দমদম। রোজ সন্ধে সাড়ে পাঁচটা থেকে তিনটে নাটক, দু’দিনে মোট ছ’টি: খিচুড়ি অখনো ফুটে লাই, হিমু, লাভ স্টোরি, জল, সীমানা-পারাপার, গাধায়ণ। সাম্প্রতিক কালের অনেক নাটকে দর্শনের সঙ্গে অভিনেতার জীবনচর্যার অসঙ্গতি প্রকট, মত উদ্যোক্তাদের। নাটকের অভিনেতা যেন এক শ্রমিক, উৎপাদিত দ্রব্যে যার হক নেই, নেই প্রত্যক্ষ যোগ। সেই অধিকারের কথা মনে করাতেই নাট্যে অভিনয়ে বাদল-যাপন।
ঐতিহাসিক
ব্রিটিশ আমলে শহর-পরিকাঠামো গড়ে তোলা ছিল শাসনব্যবস্থারই অংশ। আর তারই অঙ্গ ‘টাউন হল’। কলকাতায় টাউন হল স্থাপনা ১৮১৩ সালে, হাওড়ায় সে কাজ শুরু হয় তার সত্তর বছর পরে, সাধারণ্যের উদ্যোগে এবং তৎকালীন জেলাশাসক চার্লস এডওয়ার্ড বাকল্যান্ড-এর সহায়তায়। ১৮৮৪ সালের ১৪ মার্চ সেটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির গভর্নর অগাস্টাস টমসন। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণ, দেশবন্ধুর প্রয়াণে সুভাষচন্দ্রের শোক প্রকাশের সাক্ষী হাওড়া টাউন হল; শুনেছে অরবিন্দের ভাষণ, দেখেছে বিপ্লবী যতীন দাসের মরদেহ। ঐতিহাসিক ইমারতটি সাম্প্রতিক কালে খারাপ হয়ে পড়েছিল, দীর্ঘ দিন বন্ধও ছিল ‘হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃত হলটি। সুষ্ঠু সংস্কারের পর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হল গত ১১ জুলাই।