ছবি: তথাগত সিকদার
এক বার নয়, বছরে দু’বার, শরৎ ও বসন্তে দুর্গাপুজো আয়োজনের পিছনে দুর্গতি থেকে ত্রাণের আকুলতা নজর এড়ায় না। দুই ঋতুই স্বাস্থ্যের দিক থেকে বেশ বিপজ্জনক। প্রচুর মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন নানা কারণে, অনেকের মৃত্যুও হয়। এই ঋতু দুটিকে তাই ‘যমদ্রংষ্ট্রা’ বলা হয়। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির মতে, শুক্লযজুর্বেদের মহীধর-কৃত ভাষ্য অনুযায়ী অম্বিকা শরৎ রূপ গ্রহণ করে ‘কাস জ্বরাদি উৎপাদন করেন’। ঋগ্বেদের আর্যদের শরৎকালে পীড়িত হওয়া এবং সেই পীড়ার কারণ ও নিবৃত্তি হিসেবে রুদ্র উপাসনার ব্যাখ্যা দিয়ে মত দিয়েছেন, শরৎকালীন দুর্গাপূজা রুদ্রযজ্ঞের পরিবর্তিত রূপ। তাই শুরু থেকেই শারদীয়া পূজার সঙ্গে মারি ও রোগব্যাধির একটা সম্পর্ক ছিল বলেই মনে হয়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগও বার বার হানা দিয়েছে এই সময়ে। কলকাতার ইতিহাসের সব থেকে ভয়ঙ্কর দুর্যোগের মধ্যে দু’টি বিধ্বংসী ঝড় (১৭৩৭ ও ১৮৬৪ সালে) এসেছিল এই আশ্বিনেই। ১৮৬৪-র সেই আশ্বিনের ঝড় আসে দেবীপক্ষের পঞ্চমীর দিন সকাল দশটায়, চলে বেলা তিনটে পর্যন্ত। সেই ঝড়বৃষ্টির ক্ষয়ক্ষতি আজও মাইলফলক হয়ে আছে। পুজোর আয়োজন প্রভাবিত হলেও, শোভাবাজারের দেব বাড়ি বা বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বাড়ির মতো প্রাক্-বারোয়ারি যুগে বনেদি বাড়ির পুজো সে বার নিয়ম মেনেই হয়েছিল।
আঠেরো-উনিশ শতকের বাংলায় বারংবার ফসলহানি, সেই সঙ্গে দেশে আকাল ও দুর্ভিক্ষ হলেও কলকাতায় অকালবোধন কিন্তু স্তব্ধ হয়ে যায়নি। উনিশ শতকের মাঝামাঝি বাবু ভোলানাথ চন্দ্র তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত ট্রাভেল অব আ হিন্দু টু ভেরিয়াস পার্টস অব বেঙ্গল অ্যান্ড আপার ইন্ডিয়া বইতে (১৮৬৯) জানাচ্ছেন, ১৮৬৬-র দুর্ভিক্ষের বছরে কলকাতায় দুর্গাপূজার সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছিল, কিন্তু তাতেও প্রায় হাজারখানেক বাড়িতে জ্বলে উঠেছিল সন্ধিপূজার প্রদীপ। আকালের বছরগুলিতে পূজার অঙ্গ হিসেবে জোর দেওয়া হয়েছিল ব্রাহ্মণ ও দরিদ্রনারায়ণ সেবার মতো আয়োজনেও।
গত শতকে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারি-আক্রান্ত এ শহর দেখেছে মৃত্যুর মিছিল। তার মধ্যেও হয়েছে দুর্গোৎসব। নিবেদিতা স্কুলের বোর্ডিং-এর মেয়েরা বাগবাজারের বনেদি বাড়ির প্রতিমা ঘুরে দেখে আনন্দ করছে, লিখেছেন ঊষারানি মুখোপাধ্যায়। আজকের বাগবাজারের বিখ্যাত পুজোও শুরু হয় সেই অতিমারির আবহেই, ১৯১৯-এ।
এ বছর পঞ্জিকামতে দেবীর ফিরে যাওয়া দোলায়, যার ফল মড়ক। কিন্তু সেই মারি-মড়কভয় তুচ্ছ করতেই যেন আনন্দময়ীর আবাহন মন্ত্রকেই অস্ত্র করে লড়তে প্রস্তুত মহানগর। ঠিক যে ভাবে কয়েক শতক ধরে সে দুর্গাপূজা থেকে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সংগ্রামের রসদ জোগাড় করে এসেছে। মূর্তির আকার ছোট হবে, আয়োজনে হয়তো হবে কাটছাঁট। কিন্তু দুঃসময় বাদ সাধবে না দুর্গোৎসবের উদ্দীপনায়। ছবিতে কুমোরটুলি থেকে ঘরে আসার পথে ছোট্ট প্রতিমা, কয়েক বছর আগে।
মেছোবই
তাঁরা মাছ ভালবাসেন— পোষ্য হিসেবে, আড্ডা ও চর্চার বিষয় হিসেবে। ২০১৭ সালে তৈরি ফেসবুক-গোষ্ঠী পাইরেটস’ ডেন। সদস্যদের উৎসাহ স্রেফ অ্যাকোয়ারিয়ামের বিদেশি মাছে বদ্ধ নয়, দেশি নানান মাছ ও তাদের বাসস্থান, জলাভূমি ও তার সংরক্ষণ নিয়েও। ভাবনা বিনিময় হল বিভিন্ন ভৌগোলিক এলাকার মাছপ্রেমীদের সঙ্গে; চলতে থাকল বিদেশি মাছ পোষার উপায়, নৈতিকতা, দেশি জলাভূমিতে ছাড়ার বিপদ নিয়ে আলোচনা, গড়ে উঠল মাছ, জলজ প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে তথ্যভান্ডার। বৈশাখে প্রকাশ পেয়েছে মেছোবই, বাংলা ভাষায় মাছ ও জলজ প্রকৃতি সংক্রান্ত প্রথম ই-ম্যাগাজ়িন। উদ্দেশ্য, সহজ ভাষায় সবার মধ্যে মাছ ও জলজ প্রকৃতি নিয়ে সচেতনতা তৈরি। সম্প্রতি প্রকাশ পেল মেছোবই-এর পুজো সংখ্যা (ছবিতে প্রচ্ছদ)। অভিনব।
অন্তরগামী
ফরাসি লেখক আন্তোনাঁ আর্তো-র (১৮৯৬-১৯৪৮) নাট্যচিন্তা দর্শককে অন্তরের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তাঁর ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে ‘কসবা অর্ঘ্য’ তাঁর ‘থিয়েটার অব ক্রুয়েল্টি’ এবং মণীশ মিত্রর অর্গানিক থিয়েটার— দুই দর্শনকে মিলিয়েছে নতুন নাটক সাইকোসিস-এ। ইংরেজ নাট্যকার সারা কেনের শেষ নাটক, তাঁর সুইসাইড নোট বলে পরিচিত ৪.৪৮ সাইকোসিস ও আর্তো-র ভ্যান গঘ: দ্য ম্যান সুইসাই়ডেড বাই সোসাইটি-র অনুপ্রেরণা-ঋদ্ধ নাটকটি। মিশ্রমাধ্যমে উপস্থাপনার প্রথম পর্যায় হল সিকিমের চাকুম গ্রামে, দ্বিতীয় পর্যায়ে মঞ্চায়ন কলকাতায়, অ্যাকাডেমিতে, ১২ অক্টোবর সপ্তমীর দুপুরে, ৩টেয়।
অন্য শহর
কলকাতার ভিতরে যে অপরিচিত কলকাতা, সে কি আমাদের নিজস্ব সৃষ্টি? আর্থসামাজিক, ধর্মীয়, বয়স বা লিঙ্গভিত্তিক অবস্থান থেকে আমরা নিজেদের মনেই কি তৈরি করে নিই গম্য-অগম্যের বিভাজন, গড়ে তুলি এক-একটা এলাকার মানসিক মানচিত্র, যার সঙ্গে বাস্তব মানচিত্রের মিল নেই? আমাদের মগজেই কি আছে আবেগ, স্মৃতি, শব্দ, গন্ধে নির্মিত ব্যক্তিগত ভূগোল? প্রশ্নেরা উঠে এল নাগরিক কথালাপ ‘টকিং ম্যাপস’-এ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এবং ইন্ডিয়ান ফাউন্ডেশন ফর দি আর্টস-এর আয়োজনে। পার্ক সার্কাস, টিপু সুলতানের স্মৃতি-পরম্পরায় প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড, নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের মেটিয়াবুরুজের ঐতিহ্য-সফরের পাশে চেনা হল ‘অচেনা’ চিৎপুর, কালীঘাটও। বললেন উর্বী মুখোপাধ্যায়, ঈপ্সিতা হালদার, শামিম আহমেদ, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় ও সুমনা চক্রবর্তী; প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর মধুজা মুখোপাধ্যায় বললেন আমহার্স্ট স্ট্রিটের পুরনো পাড়া নিয়ে। ২৯ সেপ্টেম্বরের আন্তর্জাল-অনুষ্ঠানটি রয়েছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা-র ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে।
ক্যালেন্ডারে
বেলুড় মঠের মূল মন্দির ও স্বামী বিবেকানন্দের বাসকক্ষ, কামারপুকুরে শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির, জয়রামবাটীতে মাতৃমন্দির, বাগবাজারে মায়ের বাড়ি, দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণী মন্দির। ছ’টি ছবিতে শ্রীরামকৃষ্ণ-সারদা দেবী-স্বামী বিবেকানন্দের পুণ্যস্মৃতি ছোঁয়া স্থানগুলির ছবি উঠে এসেছে রামকৃষ্ণ মঠ, বাগবাজারের উদ্বোধন কার্যালয়ের উদ্যোগে প্রকাশিত ২০২২ সালের ক্যালেন্ডারে। ইংরেজি ও বাংলা তারিখের মেলবন্ধনে এই ক্যালেন্ডারে চিহ্নিত বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা অনুসারে উৎসবাদি ও পূজা-পার্বণগুলি। নির্দেশ করা আছে রামকৃষ্ণ-পার্ষদদের জন্মতিথি, একাদশী-অমাবস্যা-পূর্ণিমা, বাঙালি জীবনে পালিত ও উদ্যাপিত উৎসব ও ছুটির দিনাঙ্কগুলিও। প্রকাশ পেল গত ৬ অক্টোবর, মহালয়ায়।
পার্বণী
স্রেফ উৎসবের সাহিত্য নয়, পিছনে ফেলে আসা সময় ও এই বিশেষ বছরকে ফিরে দেখেছে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্রছাত্রীদের ই-ম্যাগাজ়িন অ-মৃত’র ‘পার্বণী’ সংখ্যা। প্রেসিডেন্সির বাংলার প্রাক্তনী, কবি শঙ্খ ঘোষ ও অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর সাহিত্যকৃতির কিছু অংশ ফিরে দেখার প্রয়াসের পাশে আছে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মসার্ধশতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্যও। করোনাকালে বাংলা শব্দভান্ডারে যুক্ত হওয়া নতুন শব্দ নিয়ে প্রবন্ধ, শার্ল বোদল্যের-এর জন্মদ্বিশতবর্ষ উপলক্ষে তাঁর কবিতার বাংলা অনুবাদ, আর বিশেষ আকর্ষণ— শিল্পী, ভাস্কর রমেশ পালের দুর্গাপ্রতিমার আলোকচিত্রের ডিজিটাল অার্কাইভ। শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্টজনের সঙ্গে প্রেসিডেন্সির ছাত্রছাত্রীদের লেখায় ভরা ডিজিটাল সংখ্যাটি প্রকাশ পেল মহালয়ায়।
নকশি কাঁথা
বাংলার লোকায়ত শিল্পকলার অনন্য এক পরিসর নকশিকাঁথা— যেখানে প্রয়োজনের হাত ধরে নান্দনিকতা, ব্যবহারিক চাহিদায় মেশে শিল্পরুচি। পল্লিবাংলার মেয়েরা স্বজনের ব্যবহারের জন্য কাঁথার ফোঁড়ে বোনেন ভালবাসার নকশা। লোকায়ত শিল্পের এই নিদর্শন কাছে টেনেছে রসজ্ঞ-বিশেষজ্ঞের মনোযোগ। বাংলার কাঁথা শিল্পের কদর স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত অনেক কালই, দেশে-বিদেশে। কাঁথা বুননশিল্পের প্রসারে ইদানীং বিশেষ যত্নশীল রাজ্য সরকারও, সেই যত্ন থেকেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ শারদোৎসবের প্রাক্কালে তিন বছর ধরে আয়োজন করে আসছে ‘বাংলার নকশিকাঁথা প্রদর্শনী’ ও মেলা, এ বছরও ব্যতিক্রম হয়নি। নদিয়া, হুগলি, বীরভূম, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো জেলার কুড়ি জন শিল্পী নিয়ে এসেছেন নকশি কাঁথা ও কাঁথা শিল্পবস্তুর সম্ভার। এঁদের অনেকেই জাতীয় স্তরে পুরস্কৃত ও সম্মানিত, যেমন বীরভূমের আলিমা খাতুন (নীচের ছবিতে তাঁর করা নকশি কাঁথা)। দেখা তো যাবেই, আছে কেনার সুযোগও। গগনেন্দ্র শিল্প প্রদর্শশালায় এই প্রদর্শনী ও মেলা চলছে ৭ তারিখ থেকে। ১০ অক্টোবর পর্যন্ত, দুপুর ২টো থেকে রাত ৮টা।
অচিন শিল্প
ওড়িশার রঘুরাজপুর, গঞ্জামের মতো অঞ্চলে শবর জনজাতির বসবাস। চাষাবাদ, শিকারে জীবিকা নির্বাহকারী এই জনগোষ্ঠীর জীবনের সঙ্গী নান্দনিকতাও, অপূর্ব চিত্রশৈলীর হাত ধরে। প্রাকৃতিক নানান উপাদান থেকে রং তৈরি করে ঘরের দেওয়ালে তাঁরা আঁকেন উপাস্য দেবতা ইদিতাল-সহ বন্য জীবজন্তু, বৃক্ষ, মানুষের ছবি। আলাদা ভাবে নারী বা পুরুষকে নয়, নিয্যস মানুষকেই ফুটিয়ে তোলেন তাঁরা। শবর বা সৌরা চিত্রশিল্প তাই বিষয় ও আঙ্গিকে সমানাধিকারের গল্প বলে। লোকশিল্পের পরিসরে এই চিত্রশৈলী বিশেষ অভিনিবেশের দাবিদার, অথচ ব্যস্ত শহুরে জীবন সেই শিল্প ও শিল্পীদের সম্পর্কে জানে না তত। সেই ভাবনা থেকেই পশ্চিম পুঁটিয়ারির ‘পল্লী উন্নয়ন সমিতি’-র দুর্গাপূজায় মণ্ডপসজ্জা ও অলঙ্করণে (ছবিতে) উঠে এসেছে সৌরা চিত্রশিল্পের নানা নিদর্শন। ভারতের অন্যতম প্রাচীন ও সৃষ্টিশীল এক জনগোষ্ঠীর শিল্পকৃতির সাক্ষী থাকবে এ বার শহর কলকাতা।
ফিরে দেখা
দুর্গাপূজা ঘিরে এই যে উৎসব, পঞ্চাশ-একশো বছর তা-ই হবে ভিন্ন কালের চোখে ফিরে দেখার বিষয়। টেরাকোটা প্রকাশ করল বই সেকালের সাময়িকপত্রে বাঙ্গালীর দুর্গোৎসব (সম্পাদনা: নবকুমার ভট্টাচার্য) প্রথম খণ্ড, ১২৯০-১৩৫০ বঙ্গাব্দে নবজীবন, বান্ধব, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, বসুমতী, নারায়ণ, সাহিত্য ইত্যাদি সাময়িকপত্রে প্রকাশিত ত্রিশটি প্রবন্ধের সঙ্কলন। নবীনচন্দ্র সেন, জয়চন্দ্র সিদ্ধান্তভূষণ, রজনীকান্ত ভক্তিবিনোদ, জানকীনাথ শাস্ত্রী, বিধুশেখর ভট্টাচার্য, অক্ষয়কুমার মৈত্র, বিপিনচন্দ্র পাল, পঞ্চানন তর্করত্ন, নরেন্দ্রনাথ বাগল প্রমুখের লেখায় এ যেন এক সিংহাবলোকন।