দুর্ঘটনায় মৃত অভিষেক আচার্য (ডান দিকে) এবং শিবনাথ কুন্ডু।—নিজস্ব চিত্র।
দিদি সম্প্রতি বাইক কিনে দিয়েছিলেন। দুই বন্ধুকে পিছনে বসিয়ে সেই বাইকে চড়ে শনিবার সন্ধ্যায় বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ঘুরছিলেন দমদম এলাকার বাসিন্দা, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী অভিষেক আচার্য (১৯)। বাড়ি ফেরার সময়ে বৃষ্টিভেজা রাস্তায় মোটরবাইকের চাকা পিছলে ছিটকে পড়েন তিন জনই। পুলিশ জানায়, তখনই অভিষেক এবং বন্ধু শিবনাথ কুন্ডুকে (১৮) পিষে দেয় দশ চাকার একটি লরি। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁদের। গুরুতর জখম অবস্থায় সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তাঁদের আর এক বন্ধু ঋত্বিক সিংহ। স্থানীয় সূত্রে খবর, তাঁদের কারও মাথায় হেলমেট ছিল না।
দমদম পুরসভার মানিকপুর খালপাড় এলাকায় বাড়ি ন্যাশনাল মডেল হাইস্কুলের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী অভিষেকের। মৃতের বন্ধুরা জানিয়েছেন, আগামী বুধবার তাঁর আরও একটি পরীক্ষা ছিল। শিবনাথের বাড়ি বিমানবন্দরের আড়াই নম্বর গেট সংলগ্ন মালঞ্চের কুলিন অ্যাভিনিউয়ে। দু’নম্বর গেটের আমবাগানে বাড়ি ঋত্বিকের। ওই দু’জনই একাদশ শ্রেণির ছাত্র। রবিবার অভিষেকের পরিজনেরা জানান, সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ পড়তে যাওয়ার নাম করে বাইক নিয়ে বেরোন ওই তরুণ। স্থানীয় সূত্রের খবর, কয়েক দিন আগে বাড়ির অমতে ভাইকে বাইক কিনে দিয়েছিলেন তাঁর দিদি। শিবনাথের বাড়ি হয়ে সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ ঋত্বিকের বাড়ি যান অভিষেক। ঋত্বিকের বাবা তপন সিংহ জানান, তিন জনের খিদে পেয়েছিল বলে তিনি নুডলস রান্না করেন। সেই খাবার খেয়ে বাড়ি থেকে বেরোন তিন বন্ধু।
পুলিশ সূত্রের খবর, অনেক তরুণ-তরুণীই সন্ধ্যার পরে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরবাইক ও চারচাকা গাড়ি নিয়ে ঘুরতে আসেন। রাস্তার ধারের চায়ের দোকানে বেশ কিছু ক্ষণ সময় কাটিয়ে হইহুল্লোড় করে তাঁরা রাতে ফিরে যান। ওই তরুণদের বন্ধুরা জানিয়েছেন, অভিষেকরাও প্রায় দিন সন্ধ্যার সময়ে মোটরবাইক নিয়ে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ঘুরতে যেতেন। শনিবারও তেমনই সন্ধ্যা সাতটার সময়ে বেরোন ওঁরা। এক্সপ্রেসওয়েতে চা খাওয়ার পরে রাত ১১টা নাগাদ ফেরার সময়ে ঢালাই রাস্তার মোড়ে আচমকাই অভিষেকদের মোটরবাইকের চাকা পিছলে যায়। স্থানীয়েরা জানিয়েছেন, সে সময়ে অভিষেক মোটরবাইকটি চালাচ্ছিলেন, পিছনে বসেছিলেন শিবনাথ এবং ঋত্বিক।
আহত ঋত্বিক সিংহ। —নিজস্ব চিত্র।
পুলিশ জানিয়েছে, পিছল রাস্তায় মোটরবাইকটি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে তিন জনই ছিটকে পড়েন। পিছন দিক থেকে তখন তীব্র গতিতে ছুটে আসছিল একটি ১০ চাকার লরি। চালক তাঁদের দেখে ব্রেক কষলেও রক্ষা করতে পারেননি ওই তরুণদের। অভিষেক ও শিবনাথ সঙ্গে সঙ্গে পিষ্ট হয়ে যান লরির চাকায়। ঋত্বিক কিছুটা দূরে ছিটকে পড়ায় গুরুতর জখম হলেও প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে নিমতা থানার পুলিশ এসে তিন জনকে তুলে কামারহাটি সাগর দত্ত হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে দু’জনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। পা ভেঙে ও শরীরের অন্যান্য অংশে চোট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ঋত্বিক।
স্থানীয় সূত্রের খবর, মালঞ্চের ফ্ল্যাটে সম্প্রতি ভাড়া এসেছিল শিবনাথের পরিবার। কিছু দিন আগেই তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। সেই ক্ষত শুকনোর আগেই ঘটে শনিবারের দুর্ঘটনা। স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর তাপস রায় বলেন, ‘‘কী ভাবে যে ওই পরিবারকে সান্ত্বনা দেব, বুঝতে পারছি না।’’ অভিষেকের বাড়িতে উপস্থিত তিন নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর পর্ণা দাস বলেন, ‘‘রাজ্য সরকারের তরফে বারবার এত প্রচার চালানো হচ্ছে। তবু যে কেন মাথায় হেলমেট যে পরে না!’’ ওই
দুই স্কুলপড়ুয়ার মৃত্যুর খবর পেয়ে তাঁদের বাড়িতে ছুটে আসেন বন্ধুরাও। এ দিন নিমতা থানায় এসে অভিষেকের বাবা এয়ারপোর্ট অথরিটি অব ইন্ডিয়ার কর্মী হরিদাস আচার্য বলেন, ‘‘ওঁরা তিন জন বাইক নিয়ে বেরিয়েছিল। অনেক রাত হলেও ফিরছে না দেখে খুব চিন্তা হচ্ছিল। তার পর তো খবর পেলাম, সব শেষ!’’