ফিউশনের আবহে পিছিয়ে যেন শকুন্তলা-ভিক্টোরিয়ারা

শকুন্তলা ও ভিক্টোরিয়া। এমনিতে পয়লা বৈশাখের দিনটাতেই তাদের দেখা মেলে। পেস্তা, ভ্যানিলা বা কাঁচা ছানার পাকের সেই ‘ককটেল’ সন্দেশের জন্য কোনও কোনও রসিক বচ্ছরকার দিনটার দিকেই তাকিয়ে থাকেন।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৮ ০৪:০৪
Share:

মধুরেণ: নতুন বছর উদযাপনে বাঙালির মিষ্টিমুখ। রবিবার, শহরের এক দোকানে। নিজস্ব চিত্র

বিগত যুগের সেই দুই ‘নারী’র দিন গিয়েছে।

Advertisement

শকুন্তলা ও ভিক্টোরিয়া। এমনিতে পয়লা বৈশাখের দিনটাতেই তাদের দেখা মেলে। পেস্তা, ভ্যানিলা বা কাঁচা ছানার পাকের সেই ‘ককটেল’ সন্দেশের জন্য কোনও কোনও রসিক বচ্ছরকার দিনটার দিকেই তাকিয়ে থাকেন। তবে এই নয়া বঙ্গাব্দের সূচনায় মালুম হল, সে সব সন্দেশ বাঙালির জীবন থেকে মুছে যেতে বসেছে।

উত্তর কলকাতার সিমলেপাড়ার নকুড় নন্দীর দোকানের স্বর্গগত মেজ কত্তা প্রশান্ত নন্দী বাঙালির মিষ্টি-ভুবনের পরিবর্তন নিয়ে তেড়ে ঝগড়া করতেন, ‘‘ধুর মশাই, কলকাতার রাস্তায় ক্রাইসলার, বুইক, বেবি অস্টিনের মতো গাড়ি দেখতে পান, মশাই?’’ মানে, গাড়ি যদি পাল্টায় মিষ্টি কেন পাল্টাবে না? তা নকুড় এখনও প্যারাডাইস, দেলখোস, গোলাপি পেঁড়ার মতো ধ্রুপদী সন্দেশের ধারা বজায় রেখেছে। টেকসই কড়াপাকের জলভরারও নববর্ষে জোর কদর। কিন্তু রকমারি চকলেট সন্দেশ বা বাটার স্কচ থেকে নানা কিসিমের ফলের নির্যাসের সন্দেশও দাপটে রাজত্ব করছে। সাধারণত, রবিবার করে সিমলের দোকানটিতে ভক্তকুল মুখিয়ে থাকেন পোস্তর দানাখচিত ক্ষীর-গরম মশলার পুরভরা সাবেক চপ সন্দেশটির জন্য। নতুন বছরের বিপুল অর্ডার সামলাতে সেই সৌখিন বিলাসিতা এ দিন শিকেয় তুলে রাখা হয়েছিল। বড় কত্তা প্রতীপ নন্দী ভরসা দিলেন, ‘‘আ-হা চিন্তার কী, ও তো পরের হপ্তাতেই মিলবে।’’

Advertisement

ভবানীপুরের বলরাম ময়রার ঝকঝকে বিপণিতে ভরবিকেলের ভিড়টায় কিন্তু মালুম হল, মিষ্টির দোকানের এই দিনভর বাজার ধরে রাখার নেপথ্যে বৈচিত্র্য একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। তখনও কলকাতা পুরসভায় শাসক দলের এক বিশিষ্ট চরিত্রের ফরমায়েশি মিষ্টির ডালা সাজানো চলছে। ডালায়। পেল্লায় সাইজের পার্বণকালীন মিহিদানা ঠাসা শাঁখ সন্দেশ হল মধ্যমণি। তাকে ঘিরে খেজুর ও নানা ধরনের বাদাম ভরপুর ‘ম্যাজিক লাড্ডু’, বিদেশি টিন-বন্দি আনারসের পুরঠাসা সন্দেশ, হার্ট আকৃতির চকলেট সন্দেশ, মিল্ককেক ইত্যাদি মজুত। বলরামের তরুণ কর্ণধার সুদীপ মল্লিকের কথায়, ‘‘বাঙালি নতুন সন্দেশও দিব্যি খায়। ডালায় নানা কিসিমের সন্দেশ পেলেই লোকে খুশি হন!’’ সুদীপের দাবি, বচ্ছরকার কেনাকাটার শতকরা ৭৫ ভাগই এখন সাহেবি মুসের আদলের ডাব সন্দেশ, আমের সুফলে বা চকলেট সন্দেশের রকমারি।

নতুনের এই টান ছাপ ফেলেছে মফস্‌সলেও। রিষড়ার হেভিওয়েট মিষ্টি ব্র্যান্ড ফেলু ময়রার দোকানেও জয়জয়কার হাল আমলের আমের শাঁসঠাসা মোহিনী সন্দেশের। আমের রাবড়িও ভাল চলছে। গজা, লবঙ্গলতিকা, দরবেশখ্যাত মিষ্টি-স্রষ্টারা এখন এই আমের সন্দেশের সৌজন্যেই আলাদা করে নিজেদের জাত চিনিয়ে চলেছেন।

তা বলে পুরনো মিষ্টি একেবারে লোকে ভুলতে বসেছে, সেটা ঠিক নয়। বউবাজারের ভীম নাগের দেলখোস, আবার খাব, প্যারাডাইস, আলফান্সো আম সন্দেশও বছরভর মাথা উঁচু করে রয়েছে। পাশেই নবকৃষ্ণ গুঁইয়ের দোকানে শকুন্তলা, ভিক্টোরিয়া এখনও পয়লা বৈশাখে হাজির হয়। বিকেল তিনটের মধ্যে দেখা গেল, ওই দুই ধ্রুপদী স্বাদের ভাঁড়ার খতম। তবে ছানার মুড়কি, পেল্লায় রাম বোঁদে রয়েছে। নকুড়ের বড় কত্তা এক নবীন খদ্দেরকে বোঝাচ্ছিলেন, ‘‘ভাল সন্দেশ হল স্কচের মতো। কপাকপ খেলে চলবে না। তারিয়ে তারিয়ে স্বাদটা বুঝতে হবে!’’

তবু দেওয়ালের লেখা সকলেই পড়তে পারছেন। সাহেবি ডেজার্ট মুস, ব্রুলি, ফ্ল্যানের আদলের ডাব সন্দেশ, আমসন্দেশ থেকে মিহিদানা, রসগোল্লার বেক্‌ড অবতারই ক্রমশ পাড়ার মিষ্টির দোকানেও ঢুকে পড়ছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement