ভাগাড়ের মরা পশুর মাংসই দাম দিয়ে কিনে খাচ্ছি আমরা!

আঁতকে ওঠারই কথা! কিন্তু বাস্তবে ঘটতে পারে এমনটাও। বৃহস্পতিবার দক্ষিণ শহরতলির বজবজ এলাকার একটি ঘটনার সূত্রে সামনে এসেছে এমনই এক কাহিনি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৮ ০২:২৩
Share:

রেস্তরাঁয় রান্না হচ্ছে মাংস। আগমন কোথা থেকে, জানে না কেউ। ছবি: শাটারস্টক।

ধরা যাক, আপনার পাড়ায় একটি নেড়ি কুকুর মারা গিয়েছে। দেহটি তুলে নিয়ে গিয়েছেন সাফাইকর্মীরা। ফেলা হয়েছে ভাগাড়ে। পরের দিন কোনও রেস্তরাঁয় আপনি হয়তো বিরিয়ানি খাচ্ছেন। মাংসের টুকরোয় যখন কামড় বসাচ্ছেন, তখনও আপনি জানেন না, পাড়ার ওই মৃত নেড়িই হয়তো বা উঠে পড়েছে আপনার পাতে!

Advertisement

আঁতকে ওঠারই কথা! কিন্তু বাস্তবে ঘটতে পারে এমনটাও। বৃহস্পতিবার দক্ষিণ শহরতলির বজবজ এলাকার একটি ঘটনার সূত্রে সামনে এসেছে এমনই এক কাহিনি। পুলিশ জানিয়েছে, বজবজের ওই ভাগাড় থেকে মৃত পশুর মাংস কেটে নিয়ে যাচ্ছিল কিছু যুবক। তাদের দেখে সন্দেহ হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের। ওই যুবকদের জিজ্ঞাসা করে তাঁরা জানতে পারেন, বিভিন্ন রেস্তরাঁ ও খাবারের দোকানে সরবরাহের জন্যই ভাগাড় থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছিল মৃত পশুর মাংস। বজবজের ময়লা ডিপো এলাকার ওই ঘটনায় পুলিশ আটক করেছে অভিযুক্ত ওই যুবকদের।

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজা মল্লিক নামে বজবজ পুরসভার এক কর্মীও ওই পাচার-চক্রে জড়িত বলে অভিযোগ। তদন্তে পুলিশ জেনেছে, ভাগাড়ে কবে, কোন পশুর দেহ ফেলা হচ্ছে, সেই খবর রাজাই জানাতেন ওই যুবকদের। তার পরে ওই যুবকেরা হানা দিত সেই ভাগাড়ে। জঞ্জালের স্তূপ থেকে মৃত পশুর দেহটি বার করে তার ছাল ছাড়িয়ে কেটে নেওয়া হত মাংস। সেই মাংস ছোট ছোট করে কেটে প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে পাঠিয়ে দেওয়া হত কলকাতার বিভিন্ন রেস্তরাঁ ও খাবারের দোকানে। শ্যামলাল নামে এক যুবকের ট্যাক্সিতে ওই মাংস পাচার করা হত।

Advertisement

আরও পড়ুন: দরজা খুলতেই ঝাঁপিয়ে পিৎজা ডেলিভারি বয়ের মাংস খুবলে নিল দু’টি কুকুর

দেখুন ভিডিও:

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, কেউ যাতে দেখে না ফেলে, তার জন্য ‘অপারেশন ভাগাড়’ শুরু হত গভীর রাতে। চলত ভোর পর্যন্ত। পশুটিকে খুঁজে বার করা থেকে মাংসের টুকরো প্যাকেটবন্দি করা— পুরো প্রক্রিয়াটাই রাতের অন্ধকারে চুপিসারে চলত। তার পরে সকাল হতেই শ্যামলালের ট্যাক্সিতে তুলে দেওয়া হত সেই মাংস। শ্যামলাল কলকাতার বিভিন্ন রেস্তরাঁয় তা পৌঁছে দিতেন বলে জানা গিয়েছে। ওই পাচার-চক্রে শ্যামলাল ও রাজা ছাড়া আরও ছ’জন রয়েছে বলে দাবি করেছেন তদন্তকারীরা।

এ রকম ভাগাড় থেকেই মাংস তুলে আনার অভিযোগ উঠেছে। নিজস্ব চিত্র

এ দিন সকালে শ্যামলাল ও রাজাকে স্থানীয় বাসিন্দারা ধরে ফেলেন। শ্যামলালের ট্যাক্সি ভাঙচুর করা হয়। দু’জনকেই আটক করে বজবজ থানার পুলিশ।

মৃত পশুর মাংস নিয়ে যাওয়ার সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে বজবজ পুরসভার কর্মী রাজা মল্লিক এবং ট্যাক্সিচালক।

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, বজবজ পুরসভার কর্মী রাজাই ওই ভাগাড় দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন। সেখানেই বজবজ পুর এলাকার মৃত পশুদের দেহ ফেলা হয়। প্রায় রোজই গরু, ছাগল, কুকুর, বেড়াল-সহ বিভিন্ন পশুর দেহ ফেলা হয় সেখানে। সকাল থেকে ক’টি পশুর দেহ ফেলা হল, সেই হিসেব রাখতেন রাজা। তার পরে খবর পাঠাতেন ওই মাংসের পাচারকারীদের।

শ্যামলাল ও রাজাকে দফায় দফায় জেরা করার পরে পুলিশ এই ঘটনায় মধ্য কলকাতার রাজাবাজারে এক ব্যক্তির নাম জানতে পেরেছে। তিনিও এই চক্রে যুক্ত বলে অভিযোগ। বজবজ থানা এই ঘটনার তদন্তে একটি বিশেষ দল গঠন করেছে। কলকাতার কোন কোন রেস্তরাঁয় ওই মাংস পাচার করা হত, রাজা ও শ্যামলালকে জেরা করে তা জানার চেষ্টা করছে পুলিশ। তদন্তকারীদের দাবি, প্রতিদিন ৪০ থেকে ৪৫ কিলোগ্রাম মাংস পাচার করা হত। সবটাই অবশ্য শ্যামলালের ট্যাক্সিতে নয়। ব্যবহার করা হত অন্যের ট্যাক্সিও।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন সকালে ময়লা ডিপো এলাকায় একটি এসি ট্যাক্সির চাকা বড় গর্তে পড়ে গিয়েছিল। গর্ত থেকে সেই ট্যাক্সিকে তুলতে গিয়ে পিছনের ডিকি থেকে মাংস ভর্তি একের পর এক প্লাস্টিকের প্যাকেট নামানো হতে থাকে। ওই মাংসের প্যাকেট দেখে আশপাশের বাসিন্দাদের সন্দেহ হয়। কারণ, ট্যাক্সিটা ভাগাড়ের দিক থেকেই আসছিল। ওই বাসিন্দারা ট্যাক্সির চালককে একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকেন। কয়েক জন তাঁকে মারধরও শুরু করে। তার পরেই শ্যামলাল ভাগাড় থেকে মাংস নিয়ে আসার বিষয়টি জানান। পুরকর্মী রাজাই যে এই মাংস পাচার-চক্রের পাণ্ডা, তা-ও জানান শ্যামলাল। এর পরে ভাগাড়ে গিয়ে রাজাকেও ধরেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পুলিশে খবর দেওয়া হয়। বজবজ পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান গৌতম দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘এটা অতি নিন্দনীয় ঘটনা। এমন যে ঘটতে পারে, সেটাই তো ভাবতে পারছি না! চুক্তির ভিত্তিতে রাজা নামে ওই কর্মীকে রাখা হয়েছিল। পুলিশ আইন অনুযায়ী কঠোরতম ব্যবস্থা নিক। পাচার-চক্রের সকলকে তো বটেই, কলকাতার ওই সব রেস্তরাঁর মালিকদেরও গ্রেফতার করা হোক। আমরা যথাসাধ্য সহযোগিতা করব।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement