পূর্ব কলকাতার জলাভূমি নিয়ে বিধি বদলের চেষ্টা আগেই করেছিল রাজ্য। এ বার পরিবেশ দিবসের অনুষ্ঠানের মঞ্চে দাঁড়িয়ে সেই জলাভূমিতে নির্মাণের পক্ষে সওয়াল করলেন খোদ পরিবেশমন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায়। এই কাজে মানুষের সমর্থনও চেয়েছেন তিনি। বলেছেন, প্রয়োজনে নাগরিক সমাজ এবং পরিবেশকর্মীদের সঙ্গে আলোচনাতেও বসতে রাজি তিনি।
পরিবেশগত দিক থেকে পূর্ব কলকাতার বিস্তীর্ণ জলাভূমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওই এলাকা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ‘রামসর’ তালিকাভুক্ত বলে চিহ্নিত। এমন সংবেদনশীল এলাকায় বেআইনি নির্মাণ নিয়ে একাধিক অভিযোগ হয়েছে, মামলাও রয়েছে। সেই জলাভূমি নিয়ে পরিবেশ দিবসের অনুষ্ঠানে পরিবেশমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে বিস্মিত পরিবেশকর্মীদের একাংশ। তাঁরা বলছেন, নির্মাণের ফলে জলাভূমির ক্ষতি হবে।
যদিও মন্ত্রীর যুক্তি, বিরাট জলাভূমি এলাকার একাংশে কোনও নির্মাণ হলে তাতে পরিবেশের ক্ষতি হবে না। বরং উন্নয়নের ফলে মানুষই উপকৃত হবেন। কিছু ক্ষেত্রে সেই উন্নয়ন পরিবেশকে বাঁচাবে বলেও দাবি করেছেন তিনি। পরিবেশকর্মীরা অবশ্য এই ধরনের যুক্তিকে পরিবেশবিরোধী বলেই মনে করছেন।
শোভনবাবু এ দিন বলেন, ই এম বাইপাস থেকে বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য একটি উড়ালপুল হবে। তার জন্য ৩০ হাজার একরের ওই জলাভূমির কয়েক কাঠা লাগবে। কিন্তু এই উড়ালপুল হয়ে গেলে অনেক দ্রুত বিমানবন্দরে পৌঁছনো যাবে। যানজট কম হওয়ায় ধোঁয়া কম বেরোবে। কমবে বায়ুদূষণ। তাঁর কথায়, ‘‘বিমানবন্দরে পৌঁছতে ৪৫ মিনিট কম সময় লাগবে।’’
আরও পড়ুন: রাজ্যে কি ৫৫০ ভুয়ো চিকিৎসক!
যদিও এই ৪৫ মিনিটের কোনও হিসেব শোভনবাবু দিতে পারেননি। এ ব্যাপারে নগরোন্নয়ন দফতর কোনও সমীক্ষা রিপোর্ট দিয়েছে বলেও মন্ত্রী জানাননি। ফলে কোন তথ্যের ভিত্তিতে শোভনবাবু এই কাজের পক্ষে সওয়াল করছেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরিবেশকর্মীরা। তাঁদের মতে, জলাভূমিতে একটি নির্মাণ হলেই তার চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়। এই জলাভূমির উপরে মাছ চাষ, এলাকার মানুষদের জীবিকা এবং প্রচুর পাখির জীবন নির্ভরশীল। জলাভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাই সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
গোটা বিশ্বেই জলাভূমি সংরক্ষণ নিয়ে প্রচেষ্টা চলছে। এ দিন বণিকসভা বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের একটি অনুষ্ঠানে রাজ্য জীববৈচিত্র পর্ষদের চেয়ারম্যান অশোককান্তি সান্যাল জানান, গত এক শতকে বিশ্বের ৫০ শতাংশ জলাভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তা হলে কি জলাভূমি সংরক্ষণ চায় না রাজ্য সরকার?
শোভনবাবু কিন্তু তেমন়টা বলছেন না। বরং মঞ্চ থেকে তাঁর হুঁশিয়ারি, ‘‘পুকুর, জলাশয় ভরাট করা চলবে না। আগুন নিয়ে খেলবেন না। এই কাজ করলে কোনও বন্ধু-শত্রুর বিচার না করেই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ পুকুর-জলা সংরক্ষণে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের কথাও মনে করিয়ে দেন তিনি। বলেন, ‘‘গত ক’দিনে অনেককেই বলেছি, যত বড়ই জনপ্রতিনিধি হও, পুকুর বোজানো যাবে না।’’ এখানেই প্রশ্ন তুলেছেন পরিবেশকর্মীদের একাংশ। তাঁরা বলছেন, পুকুর এবং জলাশয় ভরাট নিয়ে সরকার এত সংবেদনশীল হলে পূর্ব কলকাতার জলাভূমির দিকে তাকানো হচ্ছে না কেন? ইতিমধ্যেই তো সেখানে একাধিক বেআইনি নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে।
এ দিন ভারতীয় প্রাণী সর্বেক্ষণের প্রাক্তন অধিকর্তা এবং পরিবেশবিজ্ঞানী আশিসকুমার ঘোষ বলেন, ‘‘মন্ত্রীমশাইয়ের কাছে জানতে চাই, পূর্ব কলকাতার জলাভূমি নিয়ে সাড়ে তিনশো এফআইআর জমা পড়লেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হল না কেন?
পরিবেশবিদ স্বাতী নন্দী চক্রবর্তীর মতে, ‘‘’পূর্ব কলকাতা জলাভূমির আন্তর্জাতিক গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে নির্মাণের চেয়ে বেশি জরুরি ওই এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকার উন্নতি করা। সেই ক্ষেত্রে অনেক নতুন কাজের সুযোগও রয়েছে সরকারের সামনে।’’
জলাভূমির দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন?’’ বস্তুত, ওই জলাভূমি এলাকায় জলপ্রকল্প করতে গিয়েও আইনি ফাঁসে আটকেছিল রাজ্য। শেষমেশ সুপ্রিম কোর্ট থেকে শর্তসাপেক্ষে সেই প্রকল্প মঞ্জুর করা হয়। এ দিন যে ভাবে পরিবেশমন্ত্রী জলাভূমিতে নির্মাণ নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে রফাসূত্র বের করতে চেয়েছেন তাতে পরিবেশ দফতরের এক পদস্থ কর্তার মন্তব্য, ‘‘মামলা এড়িয়ে আদালতের বাইরেই সমাধান করতে চাইছেন উনি।’’