কাচের ওপর শিল্পকলা।
শিক্ষা ও বিনোদনে গল্পের ব্যবহার প্রাচীন। ধর্মের ক্ষেত্রেও। অনেক সময় সেই গল্প ছবিতে ফুটে ওঠে ধর্মস্থানের দেওয়ালে, চিত্র বা ভাস্কর্যের রূপে। খ্রিস্টধর্মে ধর্মীয় শিল্পের এমন আর একটি ধারা হল স্টেনড গ্লাস, কাচের উপর আঁকা ছবি। প্রাচীন রোম ও মিশরে রঙিন কাচের জিনিস তৈরির চল ছিল, ব্রিটেনে রঙিন কাচের জানলা দেখা যায় সপ্তম শতক থেকে।
ঔপনিবেশিক কলকাতাতেও গির্জায় এই ধারার ছবির প্রচলন হয়। জানলা দিয়ে আলো ঢোকার কেজো প্রয়োজনকে শহরের প্রাচীন তিনটি গির্জাই রূপ দিয়েছে স্টেনড গ্লাস-এর শিল্পকর্মে। ব্রেবোর্ন রোডের পর্তুগিজ গির্জায় স্টেনড গ্লাসের ছবিতে বিবৃত হয়েছে ঈশ্বরের দূতদের দ্বারা সেন্ট জোনাহ-কে উদ্ধারের গল্প। মিশন রো-এর মিশন চার্চে তিনটি প্যানেলে দেখানো হয়েছে জিশুর নানা রূপ। আর সেন্ট জন’স গির্জার স্টেনড গ্লাসের কারুকাজে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পবিত্র বাইবেলের বিভিন্ন কাহিনি। উনিশ শতকের শেষ দিকে হরিহর স্যান্ডেল-এর উদ্যোগে গড়ে ওঠা, ‘বাঙালি গির্জা’ নামে পরিচিত সেন্ট মেরি’জ় চার্চেও রয়েছে সুন্দর স্টেনড গ্লাসের শিল্পকর্ম। গলিত কাচের সঙ্গে নানা রঞ্জক যোগ করে তৈরি হয় এই রঙিন কাচ।
জানালায় রঙিন কাচে এই আলোর খেলার আকর্ষণ এক সময় শুধু গির্জাতেই সীমাবদ্ধ রইল না, দেখা গেল অন্যান্য উপাসনালয়েও। কলকাতায় ইহুদিদের দু’টি উপাসনালয়— বেথ-এল সিনাগগ এবং ম্যাগেন ডেভিড সিনাগগ-এও দেখা যায় স্টেনড গ্লাস। অনেক মসজিদেও দেখা যায় এই শিল্পকৃতি। গির্জার তুলনায় সিনাগগ বা মসজিদে রঙিন কাচের নকশা ও ধরন আলাদা, সেও দেখার। দিনের বেলায় আলো পড়লে এক রূপ, চাঁদের আলোয় তার অন্য চেহারা। সিনাগগ-এর তত্ত্বাবধায়কেরা পূর্ণিমার রাতে রঙিন আলোর কথা বলেন, চেনা সিনাগগ-এর অন্দরমহল যেন এক জাদুবিশ্ব হয়ে ওঠে তখন।
ঔপনিবেশিক কলকাতায় জানালার উপর রঙিন কাচের এই নকশা প্রভাবিত করেছিল ‘বাবু’দের। তাই খড়খড়ির জানালা বন্ধ থাকলেও বাইরে থেকে ঘরে আলো প্রবেশের রাস্তা হিসাবে এই রঙিন কাচের কাজ বসতে শুরু করল বাবুদের প্রাসাদে, পরে মধ্যবিত্ত বাড়িতেও। মজার কথা, আঠারো শতকেই কলকাতায় উৎপাদিত হত কাচ। কলকাতা কাছারির পুরনো নথি বলছে, ১৭৬৩ সালে রামকৃষ্ণ ঘোষ ন’শো টাকা লাইসেন্স ফি দিয়েছিলেন কাচের কারখানার জন্য। তবে ধারাবাহিক ভাবে পরের বছরগুলিতে কাচ উৎপাদনের লাইসেন্স ফি কমতে দেখে স্থানীয় উৎপাদকদের ব্যবসার হাল টের পাওয়া যায়।
গুড ফ্রাইডে চলে গেল গতকাল। শহরের গির্জাগুলিতে স্টেনড গ্লাসের সুদৃশ্য কারুকাজের দিকে কি শিল্পরসিকদের নজর পড়ে তত? প্রশ্ন জাগে কি তাদের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য নিয়ে? ছবিতে যথাক্রমে সেন্ট জন’স গির্জা ও বাগবাজারের বসুবাটীতে স্টেনড গ্লাসের শিল্পকৃতি, ছবি: অমিতাভ পুরকায়স্থ ও তথাগত সিকদার
সেবাদর্শ
জাতীয় কংগ্রেসের উদ্যোগে, জওহরলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে ১৯৩৮-এ জাপানি আগ্রাসন-বিরোধী লড়াইয়ে চিনা জনগণের সাহায্যার্থে পাঠানো ভারতীয় মেডিক্যাল মিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন ডা. দ্বারকানাথ কোটনিস (ছবি)। চিনা জনসাধারণের অক্লান্ত চিকিৎসাকাজে, চিনের এক দুর্গম পাহাড়ি গ্রামে ১৯৪২-এর ডিসেম্বরে তাঁর প্রয়াণ। তাঁর সেবাদর্শকে সামনে রেখে, মিশনের অন্য এক সদস্য ডা. বিজয়কুমার বসুর নেতৃত্বে ১৯৭৩-এ পুনরুজ্জীবিত হয় দ্বারকানাথ কোটনিস স্মৃতিরক্ষা কমিটি। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় চোদ্দোটি শাখাকেন্দ্র, আকুপাংচার চিকিৎসা পদ্ধতি-সহ বহুবিধ জনসেবার কাজে যুক্ত তারা। তাদের সূত্রে আকুপাংচার চিকিৎসা পদ্ধতির প্রসার ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গ-সহ সারা দেশে। সংগঠনের সুবর্ণজয়ন্তীতে ৯ এপ্রিল সকালে ভারত সভা হলে সম্মেলন, সাড়ে ৩টেয় প্রাক্তনী সংবর্ধনা। প্রকাশিত হবে স্মারক পত্রিকা অঙ্কুরে শুরু-র বিশেষ সংখ্যা।
কবিতার জন্য
দু’দশক আগে আত্মপ্রকাশ যাপনচিত্র পত্রিকার (সম্পাদক: প্রবালকুমার বসু), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যোগেন চৌধুরীরা ছিলেন দিগ্দর্শক। শুরু থেকেই তরুণ কবি-লেখকদের আশ্রয়স্থল এ পত্রিকা, জরুরি নানা বিষয়ে লেখা প্রকাশের মাধ্যমে প্রশ্ন করেছে সমসময়কে। ২০০৬ থেকে শুরু হয়েছে প্রকাশনাও। গত ৩১ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল শিশির মঞ্চ ও রোটারি সদনে হয়ে গেল ‘যাপনচিত্র ২০’ উৎসব— কবিতাপাঠ, বিতর্ক, আলোচনায়। কুড়ি পেরিয়ে একুশের পথে পত্রিকার নতুন উদ্যোগ তিনটি সম্মাননা: ভারতীয় ভাষায় কবিতায় অবদানের জন্য ‘যাপনচিত্র ন্যাশনাল পোয়েট্রি অ্যাওয়ার্ড’, বাংলা কবিতায় অবদানের জন্য দেবকুমার বসু নামাঙ্কিত সম্মান, বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদের জন্য যাপনচিত্র প্রচ্ছদশিল্পী সম্মান— পেলেন জীবন নরহ, অভিজিৎ বেরা ও দেবাশিস সাহা।
উৎসবনাট্য
শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সকলেই তাঁদের মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন তাঁর অভিনয় নিয়ে। সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মঞ্চাভিনয়ের পঁচিশ বছর পূর্তিতে তিনি এ বার শুধু প্রধান চরিত্রেই নন, নাটককার ও পরিচালকও: মধ্যরাতের চুপকথা নাটকে, নাট্যরঙ্গ-র প্রযোজনায়। মঞ্চস্থ হবে ‘মুখোমুখি’-র আসন্ন নাট্যোৎসবে। গ্রুপ থিয়েটারের পঁচাত্তর উদ্যাপন ও মুখোমুখি-র সাতাশ পূর্তি উপলক্ষে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণে বিলু দত্ত নিবেদিত এ উৎসবে সুরজিৎ-সহ আট জন নির্দেশকের নাটকের প্রথম অভিনয়। বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মণিকর্ণিকায় মণিকা, সুমন মুখোপাধ্যায়ের আজকের সাজাহান, পৌলমী চট্টোপাধ্যায়ের জন্মান্তর, অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়ের নিরজাসুন্দরী, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের খোক্কস, সুজন মুখোপাধ্যায়ের মহাত্মা বনাম গান্ধী এবং অর্পিতা ঘোষের তুমি ঠিক যদি ভাবো তুমি ঠিক। অ্যাকাডেমি ও রবীন্দ্রসদন মঞ্চে, ১৪-২১ এপ্রিল।
ছয় দশক
গান শিখেছেন স্বয়ং বড়ে গোলাম আলি, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ এবং বেগম আখতারের কাছে। রয়েছেন আরও গুরু। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের হাত থেকে পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার। প্রভাতী মুখোপাধ্যায় শাস্ত্রীয় গানের যে কোনও ধারায় সাবলীল, বাংলা রাগপ্রধান আর ঠুংরিতে তাঁর গায়কি যেন আখতারি বাইয়ের কণ্ঠকৃতির উজ্জ্বল উদ্ধার। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের অতি স্নেহভাজন প্রভাতী তাঁর সঙ্গীতজীবনের ছ’টি দশক পূর্ণ করলেন। বরণীয়, সক্ষমকণ্ঠ শিল্পীকুলে তিনি এখন বরিষ্ঠ গায়ক। গান গাওয়ার পাশাপাশি শিক্ষাদানে ক্লান্তিহীন এই শিল্পীর সঙ্গীতজীবনের মাইলফলক ছোঁয়ার স্মারক অনুষ্ঠান হয়ে গেল গতকাল ৭ এপ্রিল, চেতলার অহীন্দ্র মঞ্চে। সান্ধ্য অনুষ্ঠান, শিল্পীর নাম মিলিয়ে অনুষ্ঠানের নামটি ছিল বেশ— ‘প্রভাতী সন্ধ্যা’।
ভেনেজ়ুয়েলার ছবি
অস্কার নিয়ে হইচই, হলিউডি ছবি দেখা, ক্বচিৎ ইউরোপের... এমনই তো অভ্যেস, আমাদের আর লাতিন আমেরিকার ছবি দেখা হয় কই! তবুও চৈত্রশেষে সে সুযোগ মিলে যায়। ফোরাম ফর ফিল্ম স্টাডিজ় অ্যান্ড অ্যালায়েড আর্টস এবং এমব্যাসি অব দ্য বলিভারিয়ান রিপাবলিক অব ভেনেজ়ুয়েলা-র উদ্যোগে আয়োজিত হচ্ছে প্রথম ‘কলকাতা কনটেম্পোরারি ভেনেজ়ুয়েলান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’। বিগত কয়েক বছরে সেখানকার সামাজিক সঙ্কট থেকে ব্যক্তি মানুষের দ্বন্দ্ব ও টানাপড়েন ফুটে উঠেছে ছবিগুলিতে। ১০ থেকে ১২ এপ্রিল ছ’টি ছবি, নন্দন-৩’এ। দূতাবাসের পক্ষে আলফ্রেডো ক্যালডেরা-র সঙ্গে উদ্বোধনে থাকবেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় ও অশোক বিশ্বনাথন।
ঝরনা কলম
ঝরনার জলের মতো ঝরনা কলমও বুঝি ঝরে গেছে জনজীবন থেকে। বল বা ডট পেনের দুনিয়ায় ঝরনা কলমের আভিজাত্যও কি আছে আর? কলমপ্রেমীদের মধ্যে ঝরনা কলম নিয়ে নানা মজার ঘটনা: তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি একটি ঝরনা কলম দিয়ে শুধু একটিই উপন্যাস লিখতেন, সেটি পরে আর ব্যবহার করতেন না, যত্নে তুলে রাখতেন। কিংবা কন্যাকে বুদ্ধদেব বসুর বকুনি, “তোর সাহস হয় কী করে আমায় ডট পেনে চিঠি লেখার!” রমাপদ চৌধুরী ঝরনা কলম এতই ভালবাসতেন যে, পকেটমারি হয়ে যাওয়ার পর আর কখনও শেফার্সে লেখেননি। ঝরনা কলমের প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে এ বছর ‘পেন মহোৎসব-২’-এর আয়োজন করেছে ‘পেন ক্লাব’ ও কিশলয় বিনোদন সংস্থা, ১৪-১৬ এপ্রিল, আইসিসিআর-এ, ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। থাকবে হরেক দেশি-বিদেশি ঝরনা কলম। ছবিতে তারই কিছু।
ক্রেয়নে
কিছু দিন আগে এক সাক্ষাৎকারে শিল্পী জানিয়েছিলেন, এখন তাঁর কাজে জেগে উঠতে চায় তাঁর জন্মভূমির মাটির রং। সিউড়িতে তাঁর জন্ম, বীরভূম অঞ্চলের মাটিতে হাঁটলে খানিক পরেই লাল মাটির রং লাগে পায়ে, সেই রং-ই তিনি এখন খুঁজে পান ক্রেয়নে। শিল্পজীবনের দীর্ঘ পথ চলতে চলতে এখন ওই সূচনাপথের রঙেই রঙিন হয়ে উঠতে চায় শিল্পী লালুপ্রসাদ সাউয়ের চিত্রপট। ৭০/২ সেলিমপুর রোডে ‘দেবভাষা বই ও শিল্পের আবাস’-এর প্রদর্শনীকক্ষে গত ২৫ মার্চ থেকে চলছে নতুন চিত্রপ্রদর্শনী ‘ক্রেয়নস’ (ছবিতে তারই একটি), শিল্পী লালুপ্রসাদ সাউয়ের একক। মধ্য-আশিতে পৌঁছনো শিল্পীর কাছে এই চিত্রকৃতি যেন রবীন্দ্রগানের ‘সন্ধ্যার মেঘমালা’, ক্রেয়নের রঙে জেগে ওঠা সায়াহ্ন। পাশাপাশি তাঁর সাম্প্রতিক চিত্রমালায় এসে পড়েছে কালীঘাট পটচিত্রের আলোও, ভারতীয় চিত্রকলার ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। প্রদর্শনীর সূচনা হয়েছে আর এক বর্ষীয়ান শিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। দেখা যাবে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত, রবিবার বাদে প্রতি দিন দুপুর দু’টো থেকে রাত ৮টা।
কীর্তন-সন্ধ্যা
বাংলার কীর্তন কি শুধুই ধর্মসঙ্গীত? হিতেশরঞ্জন সান্যাল তাঁর বাঙ্গলা কীর্তনের ইতিহাস গ্রন্থে দেখিয়েছিলেন, কীর্তনের মধ্যে ধরা আছে বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসও। কীর্তনের পদ, গায়নভঙ্গি ও রসাস্বাদনের টানে আজও একত্র হন সমাজের নানা স্তরের মানুষ, সেই জনসমাগম দেয় ‘সঙ্ঘশক্তি’, মানুষের আত্মপ্রতিষ্ঠার বোধও। ‘বাংলার সহস্রাব্দের পদ-কীর্তন’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠান করছে রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার গোলপার্ক, আগামী ১২ এপ্রিল সন্ধ্যা ৬টায় বিবেকান্দ হল-এ। ভাষ্য ও সঙ্গীতে বিষ্ণু-পদ-গান থেকে ঘরানাদার কীর্তনের যাত্রাপথ ফিরে দেখা, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক কঙ্কনা মিত্রের নির্দেশনায়। গান শ্রীখোল এসরাজ বাঁশি পারকাশনে কীর্তনময় সন্ধ্যা।