কোস্টা রিকার আলান কাস্কান্তে বেহারানো এবং সান হোসের কনস্তানজা কারাস্কো। ছবি: শৌভিক দে
এক জনের পায়ের তলায় সর্ষে। আর এক জন অনেক দূরের দেশ থেকে এসে বিয়ে করে এখানেই থিতু হয়েছেন। কলকাতার বইমেলার মাঠ দুই ভিনদেশিকেই নিজের দেশের ছোঁয়া ফিরিয়ে দিল।
কাঠের চৌখুপি মেঝেয় সাইকেল নিয়ে বোঁ বোঁ ঘুরছিলেন কোস্টা রিকার আলান কাস্কান্তে বেহারানো। সাইকেলেই গত চার বছর ধরে দুনিয়ার ৪৩টি দেশ ঘুরেছেন উস্কোখুস্কো ছটফটে যুবক। কেরল থেকে কার্গিল— গোটা ভারতও সদ্য চক্কর মেরে এসেছেন। দেশের দূতাবাস মারফত কলকাতার বইমেলায় ‘থিম কোস্টা রিকা’র খবরটা পেয়ে সটান মিলনমেলায় হাজির আলান।
তাঁর দেশের মেয়ে, শাঁখা-পলা পরা ফুটফুটে বৌটির সঙ্গে সেখানেই দেখা হয়ে গেল। আদতে সান হোসে শহরের মেয়ে কনস্তানজা কারাস্কো কলকাতা বইমেলার খবরটা পেয়েছেন, তাঁর শ্বশুরমশাই সল্টলেকের সলিল দাসের কাছে। বর আর্যব দিল্লিতে। ঘটনাচক্রে এ সময়ে কলকাতায় শ্বশুরবাড়িতে রয়েছেন কনস্তানজা। বছর দুই হল দেশে ফেরা হয়নি। সপ্তাহান্তের বইমেলায় এক বছরের পুত্রের জন্য স্প্যানিশ শেখার বই কিনতে কোস্টা রিকার স্টলে হাজির হাসিখুশি তরুণী।
মস্কো বইমেলার প্রজেক্ট ম্যানেজার আলেনা নভোকশোনোভা, রুশ কবি ম্যাক্সিম আমেলিন এবং গোর্কি সদনের ডিরেক্টর ইউরি দুবোভয়দের আড্ডাও জমে উঠল রাশিয়ার স্টলে। সাবেক উপনিবেশের ছাপ রেখে যাওয়া কলকাতার ইমারত এবং শক্তিশালী মশক-বাহিনী— দু’টোই দেখা গেল ছাপ ফেলেছে রুশ অতিথিদের মনে। মেলার উদ্যোক্তাদের মস্কো বইমেলায় নেমন্তন্ন করলেন তাঁরা। কলকাতার হাল্কা মিহি শীতের আমেজটার জন্যও মস্কোবাসীর হিংসেটাও যেন ভালই মালুম হল।
কয়েক শো ছোট-বড় স্থানীয় প্রকাশক, নতুন-পুরনো লেখকের আশা-আকাঙ্ক্ষার মাঝে এক ধরনের আন্তর্জাতিকতার স্বাদ কলকাতার বচ্ছরকার প্রাপ্তি। পড়শি বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নের কাছেই ব্রিটিশ কাউন্সিলের স্টল। তার উল্টো দিকে বসেছে, এক টুকরো কোস্টা রিকা। সুদূর এই দেশের খাবার দাবারের স্বাদও বুধবার চেখে দেখতে পারবে বাংলা। ছোটখাটো একটা চক্রের আদলে ওই তল্লাটে মিশে গিয়েছে চেনা-অচেনা নানা দেশের গন্ধ। মেক্সিকো, কলম্বিয়া, এল সালভাদোর, ভেনেজুয়েলা, গুয়াতেমালা, ইকুয়েডর, রাশিয়া, ফ্রান্স, জাপান, ব্রিটেন...! বিদেশি ভাষার বই কেনার সুযোগ কম, তবে দেখার উৎসাহ কম নয়। ভিন্ দেশে পড়তে যাওয়া বা বেড়ানোর সুলকুসন্ধানও মিলছে স্টলে স্টলে। জায়ান্ট স্ক্রিনে শেক্সপিয়রের নাটক দেখাচ্ছে ব্রিটিশ কাউন্সিল, কলকাতা ঠায় বসে।
কলকাতার স্প্যানিশ ভাষাবিদ, ইন্দো-হিস্পানিক ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাকাডেমির কর্তা দিব্যজ্যোতি মুখোপাধ্যায় দেখা গেল সদা ব্যস্ত। স্প্যানিশভাষী অতিথিদের বাতচিত তাঁকেই তর্জমা করতে হচ্ছে। শনিবারের বিকেলে কলকাতায় মোলাকাত হল ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রদূত আগুস্তো মন্তিয়েলের সঙ্গে। এ দেশের মতো ভেনেজুয়েলাও সাম্প্রতিক অতীতে নোট-বন্দির ধাক্কায় টালমাটাল হয়েছে। তাদের সব থেকে চালু টাকা ১০০ বলিভারের নোট বাতিলের দরুন জোর হই চই হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা শুনতে সোৎসাহে জড়ো হল কলকাতা।
ছুটির দুপুরে শহরের স্কুলপড়ুয়াদের জন্যও মেলার মাঠে ছিল বিশেষ উপহার! বুকলাভার্স কাফে। সিইএসসি-র উদ্যোগে কিশোর পাঠক-পাঠিকাদের সঙ্গে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, ব্রাত্য বসু, অরিন্দম শীলদের আড্ডা বসল। ক্যালকাটা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, সেন্ট জোসেফ স্কুলের প়ড়ুয়া বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গী খুদেদের সৃষ্টিশীল আঁকাআঁকি নিয়ে নামী লেখক-অভিনেতা-পরিচালকদের আলাপ জমে উঠল। ছোটদের জন্য মেলার এই ‘কাফে’ বসবে দফায় দফায়।
দেশ-বিদেশকে ডাক দিলেও বইমেলার ভবিষ্যৎ তো এই খুদেরাই!