আরও এক পুর নির্বাচনের প্রতীক্ষায় কলকাতা। এ শহর নিয়ে কী ভাবছেন ওঁরা?
Women Security

KMC Election 2021: আমরা মেয়েরা ভর্তুকি চাই না, পথে বেরোলে যেন স্বস্তিটুকু পাই

আমরা মেয়েরা ভর্তুকি চাই না, নিখরচায় কিছু চাই না। কিন্তু যা হয়ে উঠতে চাই, সেটুকুর সুযোগ যেন পাই।

Advertisement

শাশ্বতী ঘোষ (অধ্যাপিকা ও সমাজকর্মী)

শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২১ ০৫:৪৪
Share:

প্রতীকী ছবি।

ছোটবেলায় ইস্কুলে যেতাম হেঁটেই। বাসের হিসাবে তিনটি স্টপ। সেটুকু হাঁটতেই হবে। বাড়ি থেকে যে বাসে যাতায়াতের পয়সা দেওয়া হত না। সরকারি ইস্কুলে টিফিন নিখরচায়। কাজেই সে পয়সাও নেই। অতএব যে বন্ধুদের জ্যামিতির বাক্সে দশ টাকার একটি নোট থাকত, তাদের হিংসে করা ছাড়া উপায় কী! তাদের মধ্যে বেশ ক’জন সহৃদয় যখন ইস্কুল-ফেরত ফুচকা বা চুরমুর খাওয়াত, তখন ভারী আহ্লাদ হত! সাড়ে চার দশক আগে ইস্কুলবেলায় গৃহশিক্ষকের চল ছিল না। তাই দোকান থেকে জিনিস এনে দেওয়া ছাড়া বেরোনোর সুযোগ নেই, অথচ বাইরের আকর্ষণ তো কম নয়! ফলে মাকে সব সময়ে প্রশ্ন, ‘কিছু আনতে হবে মা?’ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পড়তে ঢুকে তাই বেশ ছাড়া-গরুই হয়ে গেলাম।

Advertisement

ইস্কুল থেকে টিউশনি, খেলা থেকে আঁকা— পরের প্রজন্মের সবেতেই অভিভাবকেরা সঙ্গী। বাসস্টপে নিতে-দিতে বা পুরো সময়ের জন্য। হ্যাঁ, তবুও কিশোরী, নবমের ছাত্রী চন্দ্রাণী চৌধুরীকে অ্যাসিড ছুড়ে হত্যার ঘটনা তিরিশ বছর আগে ঘটেছে। তখনও কয়েকটি চায়ের দোকান, সন্ধ্যা নামলে কতগুলো মোড় এড়িয়ে ঘুরপথে যাওয়া বা একা থাকলে সংক্ষিপ্ত পথের গলি না মাড়ানোর পইপই শিক্ষা যেমন এসেছে, তেমনই ভাল-মন্দের প্রভেদ নিজেদের বুঝে নিতে হয়েছে। বাইরের পরিসরের এই ভয় কতটা বাস্তব আর কতটাই বা অভিভাবকসুলভ অতি সতর্কতা, সব সময়ে তফাত করতে পারি না। তবে আগেও যেমন ছিল,
এই স্মার্টফোনের যুগে আরও বেশি, সঙ্গী অভিভাবককে ধোঁকা দিয়ে কিশোরী মেয়েটির অবাঞ্ছিত কারও সঙ্গে জড়িয়ে বিপদে পড়ার ঘটনা নিয়মিতই ঘটছে।

তখন মেয়েদের ইস্কুল বা কলেজের চারপাশে বা তাদের যাতায়াতের পথে বাইক ও গুটখাবাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি মোটে ছিল না। কিন্তু মেয়েদের ইস্কুল বা কলেজের পাশে বাইরের ছেলেরা উৎসাহ নিয়ে হাজির থাকত। সম্ভবত আড়াই দশক আগে, সুমনবালা সাহু এবং সৌমেন মিত্র তখন কনিষ্ঠ পুলিশ আধিকারিক। আমাদের উত্তর কলকাতার কলেজে তাঁরা এলেন ২৪০ বাস রুট ধরে আসা বা স্থানীয় ছাত্রীদের হেনস্থার শিকার হতে হয় কি না, তা জানতে। তার পরে নাকি উত্তরের কলেজগুলিতে বাইরের লোকের ভিড় কিছু দিন কমেছিল। আবারও সে রকম উদ্যোগ আর নিয়মিত নজরদারি চালানো যায় কি?

Advertisement

মেয়েরা বেরোবেন দিনে-রাতে, পড়তে, খেলতে, কাজ করতে, ডাক্তারের কাছে যেতে, কেনাকাটা করতে, সংগঠন করতে, জানা-অজানা নানা উদ্দেশ্যে। তাঁদের ‘বাইরের পরিসর’টা নিরাপদ করার প্রথম আর প্রধান দায়িত্ব প্রশাসনের। হেনস্থার ঘটনা ঘটলেও মেয়েরা সহজে অভিযোগ দায়ের করতে চান না, কারণ তাঁকেই যে কাঠগড়ায় তোলা হবে। তবু যখন কোনও মেয়ে অভিযোগ দায়েরের কথা ভাববেন, তাঁকে যেন যথোপযুক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়।

আমরা মেয়েরা ভর্তুকি চাই না, নিখরচায় কিছু চাই না। কিন্তু যা হয়ে উঠতে চাই, সেটুকুর সুযোগ যেন পাই। এমনিতেই যে বিষয় পড়তে চাই, সেটা যদি না-ও থাকে, তবু বাড়ির কাছে মেয়ে কলেজে না পড়লে পড়াবেই না, বা নাইট ডিউটি থাকলে কাজই করতে দেবে না— এ রকম শর্তে অহরহ জীবন কাটে বহু মেয়ের। তাই যেটুকু বেরোব, সেটুকু স্বস্তিদায়ক হোক। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বাড়ি আর চারপাশকে বুঝে নেওয়া তো মেয়েদের হাতেই থাকবে। এসপ্লানেডে নেমে বাস বদলাতে, পার্ক স্ট্রিটে গিয়ে ফিরতে, সায়েন্স কলেজে রাত করে ল্যাবরেটরি থেকে বেরোতে— আমার কলকাতাকে আরও কাছে টানতে এই সব ‘পারা’গুলো এখনই চাই।

তাই তৈরি হোক আরও শৌচাগার। চিহ্ন দিয়ে তার নির্দেশ দেওয়া থাকুক। সেখানে অবাঞ্ছিত লোক যেন ভিড় না করে। যাতে মেয়েরা পড়াশোনা,খেলা, কাজে বা আনন্দে বেরিয়ে শৌচাগারের অভাবে সারা দিন জল না খেয়ে অসুখ বাধিয়ে না বসেন। রাস্তায় থাকুক যথেষ্ট আলো। তৈরি হোক শুধু মেয়েদেরই বিশ্রামের নিভৃত পরিসর। যেখানে মেয়েরা দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিয়ে বেরোলেও একটু বসতে, প্রয়োজনে স্তন্যপান করাতে পারবেন। আমরা ‘বাইরের’ সমতা অর্জন করতে পারলেও ঘর তো আমাদের এখনও ছাড়েনি। তাই ‘বাইরে’ও আমাদের ঘরের জন্যে একটু নিভৃতির ব্যবস্থা তো করতেই হবে, তবেই আমার কলকাতা আরও আপনজন হয়ে উঠবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement