বেহাল: জল ভরেছে কচুরিপানায়, পাড়ে আবর্জনা। এ ভাবেই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে বাঁশদ্রোণীর একটি পুকুর। নিজস্ব চিত্র
বাজারের পাশেই বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে বড় একটি পুকুর। সেই পুকুরের পাড়ে জায়গায় জায়গায় জমে আছে আবর্জনা। দীর্ঘ দিন সাফাই না হওয়ায় যা কার্যত স্তূপের আকার নিয়েছে। পুকুরের জল এতটাই নোংরা যে, পা ডোবানোরও অযোগ্য। বাঁধানো ঘাটের পাশেই সেটির উদ্বোধনী ফলক। কিন্তু ঘাটের অবস্থাও বেহাল। সংস্কারের ছোঁয়া যে বহু দিন লাগেনি, তা বেশ স্পষ্ট। বাঁশদ্রোণী বাজার সংলগ্ন ওই পুকুরের প্রসঙ্গ তুলতেই স্থানীয় এক বাসিন্দা বললেন, ‘‘আবর্জনা সাফাই থেকে পানীয় জল, কোনও পরিষেবাই এখানে ঠিক মতো মেলে না। পুকুর সংস্কার তো দূরের কথা!’’ শুধু ৯৮ নম্বর ওয়ার্ডের ওই পুকুর নিয়ে নয়, গোটা ১০ নম্বর বরো জুড়েই পানীয় জল, জঞ্জাল পরিষ্কার-সহ একাধিক পুর পরিষেবা নিয়ে অভিযোগ রয়েছে বাসিন্দাদের।
অভিযোগ, ভোটের আগে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল অনেক। কিন্তু পরে তার অধিকাংশই পূরণ করা হয়নি। এর মধ্যে পানীয় জলের সমস্যাটাই সব চেয়ে বেশি। ১০ নম্বর বরোর বহু বাড়িতেই এখনও মিষ্টি
জল বা গার্ডেনরিচের জল এসে পৌঁছয়নি। বিজয়গড়, রিজেন্ট এস্টেট, রানিকুঠি ও নেতাজিনগরের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ জল নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন। বাঁশদ্রোণীর চন্দন শর্মা বললেন, “দিনে তিন বার পুরসভার জল আসে। সেই জল খাওয়া তো দূর, জামাকাপড়ও কাচা যায় না। জল কিনে খাই।’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘আমরা গার্ডেনরিচের জল কবে পাব?” আর এক বাসিন্দা বিশ্বজিৎ সাহার কথায়, “পুরসভার জলের উপরে ভরসা করতে পারি না।”
পুরসভার ৮১, ৮৯, ৯১, ৯২, ৯৩, ৯৪, ৯৫, ৯৬, ৯৭, ৯৮, ৯৯ ও ১০০ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত ১০ নম্বর বরো। কলকাতার বড় আকারের বরোগুলির অন্যতম এটি। এই বরোর অধীনে এক দিকে যেমন রয়েছে টালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে মাঝেরহাট সেতু পর্যন্ত বিস্তৃত অংশ, অন্য দিকে রয়েছে ঢাকুরিয়া স্টেশন সংলগ্ন রাস্তা, গল্ফ গ্রিন, লর্ডসের মোড়, বিজয়গড়, রিজেন্ট এস্টেট, রানিকুঠি, নেতাজিনগর, বিদ্যাসাগর কলোনি, শ্রী কলোনি, রামগড়, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড ও যোধপুর পার্ক। দক্ষিণ কলকাতার এই বরোয় বেশ কিছু বস্তি রয়েছে। আর রয়েছে বস্তি উন্নয়ন নিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ। তাঁদের প্রশ্ন, মডেল বস্তি তৈরি করা গেল না কেন? কেনই বা প্রতি বছর বস্তি উন্নয়নের টাকা কমছে?
১২টি ওয়ার্ডের মধ্যে চারটি বর্তমানে বামেদের দখলে। বাকি সব ক’টিই তৃণমূলের। বিরোধীদের অভিযোগ, উন্নয়নের প্রশ্নে ‘আমরা-ওরা’র সমস্যা রয়েছে। স্থানীয় পুর প্রতিনিধিকে বাদ রেখেও উন্নয়নের কাজ করা হয় বলে অভিযোগ। ৯৮ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কোঅর্ডিনেটর মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তীর কথায়, “দলমত নির্বিশেষে উন্নয়নের বড় সহায় হল ওয়ার্ড কমিটি। সেটা তো বলে বলেও করানো গেল না। যে কাজ পুর প্রতিনিধির করার কথা, বহু ক্ষেত্রেই তা করা হয় শাসক দলের দলীয় কার্যালয় থেকে।’’ জলের সমস্যা নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে ঘোষণা করেছিল, টালিগঞ্জে জলের সমস্যা মেটানো হবে। কিন্তু কোথায় মিটল?’’
৯৫ নম্বর ওয়ার্ড ও বরোর কোঅর্ডিনেটর তপন দাশগুপ্ত অবশ্য পানীয় জলের সমস্যার কথা মেনে নিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘গোটা বরো জুড়ে উন্নয়নের অনেক কাজই হয়েছে। তবে কিছু এলাকায় পানীয় জলের সমস্যা রয়েছে। এখন গার্ডেনরিচের জল অনেকেই পাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার গভীর নলকূপের সঙ্গে গার্ডেনরিচের মেশানো জল পাচ্ছেন। ওই জলে আর্সেনিকের সমস্যা তেমন নেই। গল্ফ গ্রিন ও প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের আশপাশের এলাকায় পানীয় জলের সমস্যা নেই বললেই চলে।’’ তপনবাবুর মতে, “বুস্টার পাম্পিং স্টেশন তৈরি হচ্ছে। সেই কাজ শেষ হলেই জলের সমস্যা মিটবে।’’
অভিযোগ রয়েছে বেআইনি নির্মাণ নিয়েও। পুর আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একের পর এক বাড়ি তৈরি হচ্ছে বলে অভিযোগ। বিজয়গড়, রানিকুঠি, শ্রী কলোনি, রামগড় ও যোধপুর পার্ক সংলগ্ন কলোনি এলাকায় তৈরি হয়েছে এমন অসংখ্য বহুতল। বিজয়গড়ের বাসিন্দা সন্দীপ ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘ছোট ছোট জমি। পুর আইন মেনে সব দিক ছেড়ে বাড়ি করতে গেলে বহুতল হবে না।’’ বেআইনি নির্মাণ বন্ধ করতে পুর আইন সংশোধনের কথাও বলছেন কোঅর্ডিনেটরদের একাংশ।
এই বরোর টালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে মাঝেরহাট সেতু পর্যন্ত অংশ ৮১ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত। এলাকার তৃণমূল প্রার্থী জুঁই বিশ্বাসের দাবি, ওই ওয়ার্ডের ১০০ শতাংশ বাসিন্দাই গার্ডেনরিচের জল পান। রয়েছে ১১ হাজার বর্গফুটের কমিউনিটি হল। রাস্তায় এলইডি আলো। বস্তির উন্নয়নও হয়েছে বলে দাবি জুঁইয়ের। তবে তারাতলা মোড়ে জল জমার সমস্যা দূর করার কাজ এখনও বাকি।
এই বরোর ৯৩ নম্বর ওয়ার্ডের বেশ কিছুটা এলাকা যোধপুর পার্ক ও লেক গার্ডেন্সের মধ্যে পড়ে। ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী শম্পা ঘোষ বললেন, ‘‘এলাকার বাজারগুলি নোংরা। রাস্তার সৌন্দর্যায়ন দরকার। এখানকার আবাসনগুলিতে অনেক বয়স্ক মানুষ একা থাকেন। তাঁদের কথা কোনও পুর প্রতিনিধি ভাবেননি।’’
কিছু এলাকায় বেহাল রাস্তা নিয়েও অভিযোগ রয়েছে। বরো কোঅর্ডিনেটর বলছেন, ‘‘যেটুকু রাস্তা ভাঙাচোরা আছে, সেগুলিও সারানো হচ্ছে। করোনা উন্নয়নকে অনেকটাই স্তব্ধ করে দিয়েছে। ঠিকাদারেরা কাজের টাকা ঠিকমতো পাচ্ছেন না। ফলে, টেন্ডার ডাকা হলেও অনেকে তাতে অংশ নিচ্ছেন না। তবে আশা করি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলে উন্নয়নের কাজেও গতি বাড়বে।”
সত্যিই কি বাড়বে? সন্দিহান ৯১ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কোঅর্ডিনেটর, সিপিএমের অন্নপূর্ণা দাস। তিনি বলেন, ‘‘পানীয় জলের সমস্যা যেমন ছিল, তেমনই রয়েছে। আমার ওয়ার্ডে কিছুটা অংশে বস্তি রয়েছে। সেই বস্তি উন্নয়নও কার্যত কিছুই হয়নি।’’
গত বিধানসভা ভোটে এই বরোয় অনেকটাই এগিয়ে ছিল তৃণমূল। তাই পুর ভোট নিয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী তৃণমূলের ওয়ার্ড কোঅর্ডিনেটরেরা। কিন্তু বিধানসভার ভোট আর পুর ভোটের সমীকরণ এক নয় বলেই মনে করছেন বিরোধীরা। তাঁদের মতে, এলাকার মানুষের পাশে সব সময়ে তাঁরাই ছিলেন। যার ফল মিলবে ভোটে। আর শাসক দলের মতে, গত কয়েক বছরে এলাকার প্রভূত উন্নয়ন দেখেছেন বাসিন্দারা। তাই জয় নিশ্চিত।