ফাইল চিত্র।
আদ্যন্ত নাগরিক আমি। এ শহরেই জন্ম। আমি নিশ্চিত যে, এখানেই মৃত্যুও আসবে। এ শহর আমাকে স্বপ্ন আর নিরাশা, দুই-ই দেখিয়েছে। নানা কাজে এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো, পরে থিয়েটারে থিতু হওয়া— সবই এ শহরের দান। কাজেই সেই কলকাতায় কেমন আছি, বলতে গিয়ে মনে হচ্ছে নিজের ঘরে আবার কেমন থাকতে পারি? অনেক অপছন্দ সত্ত্বেও যাঁরা নিজের ঘরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারেন না, তাঁরা বড় দুর্ভাগা। আমি সে রকম দুর্ভাগা নই। নিজের ঘর আর চেনা মানুষের সঙ্গে সবটা ভাগ করে নিতে পারি।
জন্ম-বাস্তুহারা। আট ভাই-বোনের সবার ছোট। ছ’মাস বয়সে বাবাকে হারিয়েছি। বহু কষ্ট করে মা আমাদের বড় করেছিলেন। সেই সুবাদে শহরে অসংখ্য বাড়ি বদলেছি। দেখেছি অনেক চরিত্র। বাঙাল আর কমিউনিস্টের সমাহারে বাড়িতে লোক লেগেই থাকত। রাতে শোয়ার জন্য কখনও ঠাঁই হত বারান্দায়, কখনও সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ, কখনও বা ছাদে। খোলা ছাদে বৃষ্টির দিনে ত্রিপল গায়ে দিয়ে শুনতে মজা লাগত জলের ফোঁটা পড়ার শব্দ। বারান্দায় যখন গভীর ঘুমে, অনুভব করতাম ভারী কিছু গায়ে পড়ল। উঠে বুঝলাম, কমিউনিস্ট সেজদার ট্রাম কোম্পানির কোনও সঙ্গী মধ্যরাতে ঠাঁই নিয়েছেন পাশে। জীবনের ভাল, মন্দ, কষ্ট— সবটা উপভোগ করছি।
রাজনৈতিক সমাজের প্রতি আমার আশা-ভরসা নেই। তাদের কাছ থেকে দায়িত্ববোধ আশা করার অর্থ, সোনার পাথরবাটি চাওয়া। পরিণতমনস্ক রাজনীতিবিদ হলে কি কোনও প্রার্থী তাঁর আগামী পাঁচ বছরের মূল কাজের দায়িত্ব হিসাবে ‘কমিউনিটি হল’ তৈরির কথা বলবেন? সুতরাং আমরা যাঁরা সমাজে বাস করি, তাঁরাই যদি আশপাশটুকু সুন্দর করার আগ্রহ দেখাই, গোটাটা সেজে উঠবে। সচেতন ভাবে ‘আগ্রহ’ শব্দটা ব্যবহার করলাম। দায়িত্ব শব্দটা বড্ড ভারী, কেউ নিতে চান না।
বিবেকানন্দ রোডে আমার বাড়ির সামনেই একটা বিন আছে, যেখানে ময়লা ফেলা হয়। তবে ভিতরে যতটা যায়, বাইরে তার বেশি পড়ে। আমার প্রতিবেশী, ‘প্রতিকম’ যাঁরা— তাঁরাই কাণ্ডটি করেন। আগে চেঁচামেচি করতাম। এখন বুঝেছি, স্বভাবকে চিৎকার করে বদলানো যায় না। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, স্বভাব বদলানোর চেষ্টা মানে তপ্ত তাওয়ায় হাত পাতা।
বাড়ির সামনের নিমগাছটা তেতলা ছুঁতে চলেছে। একে চারা থেকে গাছ করতে কখনও রাস্তায়, কখনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে পুলিশগিরি করতাম। কারণ, বহু লোক দুটো পাতা নেওয়ার জন্য গোটা ডাল ভেঙে নিয়ে যেত। দুঃখ লাগে এই ভেবে যে, আমার শহরে অনেক কিছুর চর্চা নেই। সামান্য দু’টি সবুজের ছোঁয়া কী ভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, সেই দায়িত্ব নেই। রাস্তা পরিষ্কার রাখার দায় নেই। অকারণ ওভারটেক করা গাড়ি গোটা গতিকে থামিয়ে জট পাকিয়ে দিতে পারে, এটা কলকাতার বৈশিষ্ট। এমন অসংখ্য দুর্দশাকে অবশ্য আমি মজার ছলে সামলে নিতে পারি। কারণ এ তো আমার শহর, আমার ঘর।
শ্যামবাজারের বাড়িতে যখন থাকতাম, আমার ফেরার সময়ের দিকে নজর রাখতেন এক বয়স্ক প্রতিবেশী। সর্বক্ষণ ফুটপাতে টুল নিয়ে বসে থাকতেন। শ্যাম পার্ক থেকে ঘরে ঢুকতে ছ’টা পেরিয়ে গেলেই হুমকি দিতেন, ‘দাঁড়া তোর দাদাকে বলছি।’ মনে মনে ভাবতাম, তোমার কী বাবা! আমার বাড়িতে আমি কখন ঢুকব, তুমি কে বলার? কিন্তু মনেই আওড়াতাম। বলা হয়ে ওঠেনি কখনও। রক্ষণশীলতার মতো বেশ কিছু ত্রুটি সত্ত্বেও এই দিকগুলো একটা পাড়াকে সজীব রাখত। রকের আড্ডা, পাড়ার মধ্যে এই সম্পৃক্ততা হারিয়ে গিয়েছে। যা সমাজের চরিত্রে বদল এনেছে।
এখন মনোভাব অনেকটা এ রকম, ‘আমার মেয়ে প্রথম হবে, কিন্তু প্রতিবেশীর সন্তানটি যেন ফেল করে। তাকে পাশ করতেও দেখতে চাই না।’ বিশ্বায়নের দৌলতে ভোগবাদী সমাজের এই আত্মসর্বস্বতা গিলে নিচ্ছে আমার কলকাতার অন্য শহরের চরিত্র। সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রেও শহরের পরিবর্তন এসেছে। আগে থিয়েটার সমাজ নির্ভর করত মানুষের উপরে। শুরুতেও নান্দীকার সরকারি অনুদান নয়, সাধারণ মানুষকেই ভরসা করত। আজ মনে হয়, ওই ভরসাস্থলটা একটু নড়বড়ে হচ্ছে।
বদল এসেছে এ শহরের মৌলিক চরিত্রেও। বহু বছর মিছিলের শব্দ পাই না। ‘করতে হবে’, ‘গড়তে হবে’ স্লোগানে অপ্রয়োজনীয়, প্রয়োজনীয় বা অতি প্রয়োজনীয় মিছিলগুলো আর দেখা যায় না।
অর্থাৎ, হারিয়েছে শহরের প্রতিবাদী সমাজ। হয় আমরা সহ্য করতে শিখে গিয়েছি, কিংবা গ্রহণ করে নিয়েছি।