বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য।
পুরসভা হচ্ছে তৃতীয় স্তরের একটি স্বাধীন, স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা। কলকাতা পুরসভা পরিচালনার জন্য ১৯৮০ সালে যে আইন তৈরি হয়েছিল, তার মুখ্য উদ্দেশ্যই ছিল ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। মেয়র পারিষদ পদটিও তৈরি হয়েছিল, যাতে বিভিন্ন দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে নির্বাচিত কাউন্সিলরেরা স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারেন। ওই আইনেই বিভিন্ন বরো তৈরি হয়েছিল। অর্থাৎ, আরও গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ। ক্ষমতার এই বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে পরিকল্পনা রূপায়ণের ক্ষেত্রে বরোগুলিরও নির্দিষ্ট ভূমিকা ছিল। আরও কিছুটা গণতন্ত্রীকরণের উদ্দেশ্যে বাম আমলে আমরা ওয়ার্ড কমিটি তৈরির চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সফল হইনি। মূলত তৃণমূলের কাউন্সিলরেরা তাতে আপত্তি করেছিলেন। গণতন্ত্র সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে বাম আমলে আমরা অনেকটাই সফল হয়েছিলাম। যার ফলে বিরোধীরা কখনওই আমাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আনতে পারেননি। আজও আনেন না।
পুর পরিষেবা বলতে মূলত বোঝায়, ১৯৮০ সালের আইনে নির্দিষ্ট করা কিছু দায়িত্ব। যেমন, নিকাশি, পানীয় জল সরবরাহ, জনস্বাস্থ্য, বস্তি উন্নয়ন ছাড়াও প্রাথমিক শিক্ষা, অর্থাৎ পুর বিদ্যালয় পরিচালনা। ওই সমস্ত দিক-নির্দেশকে মাথায় রেখেই ২০০৫-’১০ সালে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়িত করেছিলাম। যার মধ্যে রয়েছে প্রাচীন ‘ব্রিক সুয়্যার’ সংস্কার, যাকে এ শহরের নিকাশির প্রাণ বলা যায়। প্রায় ১৫০ বছরের পুরনো ইটের তৈরি সেই নিকাশি পথের সংস্কার ও উন্নয়ন করেছিলাম। সেই কাজের বাস্তব স্বীকৃতি হিসাবে ২০১০, ’১১ ও ’১২ সালের অতিবৃষ্টিতে জল জমলেও তা দ্রুত নেমে গিয়েছিল। কেইআইআইপি প্রকল্পে সংযুক্ত এলাকার নিকাশির উন্নয়নে বেগড় ও মণি খাল সংস্কারে জোর দেওয়া হয়। এ সমস্ত পরিসংখ্যান পুর নথিতেই পাওয়া যাবে। তাই পরিসংখ্যান দিয়ে লেখা ভারী করতে চাই না।
২০০৫-এ আমরা পুরবোর্ডে ক্ষমতায় আসার পরে শহরে ব্যাপক ডেঙ্গি দেখা দেয়। সেই রোগ নিয়ন্ত্রণে ওয়ার্ড-ভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় জোর দেওয়া হয়। বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শও কার্যকর করা হয়েছিল। ১৪১টি ওয়ার্ডের স্বাস্থ্য ইউনিটগুলিকে ঢেলে সাজানো হয়েছিল। সেই কাজে বিরোধী কাউন্সিলরদের সহযোগিতা নিতে দ্বিধা করিনি। আমাদের সময়ে ই-পরিষেবা চালু করা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। গর্ব করে বলতে পারি, ওই পরিষেবা প্রথম চালু করেছিলাম বিরোধী-পরিচালিত ন’নম্বর বরোয়। যার চেয়ারম্যান ছিলেন ফিরহাদ হাকিম। সেই কেন্দ্র চালু করতে ফিরহাদ পর্দার আড়াল থেকে আমাদের সাহায্য করলেও প্রত্যক্ষ ভাবে উপস্থিত থাকতে পারেননি। আমরা কিন্তু তথাকথিত রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার দোহাই দিয়ে বিরোধী-পরিচালিত বরো বলে উপেক্ষা করিনি।
আমরা ক্ষমতায় এসে জেনেছিলাম, পলতার পরিস্রুত জলের শতকরা প্রায় ৩০ ভাগই জরাজীর্ণ পাইপের কারণে নষ্ট হয়। সেই কারণে জলের পাইপ পরিবর্তনের জন্য ৩২০ কোটি টাকার কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অনুমোদন আদায় করেছিলাম। পরবর্তীকালে পানীয় জল পরিষেবার গুণগত পরিবর্তন দেখেছিল শহর।
সংযুক্ত এলাকায় পানীয় জলের সরবরাহ বাড়াতে অনেক বাধা পেরিয়ে ধাপায় ‘জ্যোতি বসু জল প্রকল্প’ চালু করেছিলাম। পরে তৃণমূলের বোর্ড ক্ষমতায় এসে সেটির নামকরণ করে ‘জয়হিন্দ জল প্রকল্প’। একই ভাবে ই-পরিষেবার উন্নয়নের স্মারকও তুলে দেওয়া হয়েছে। এ ভাবেই ইতিহাসকে মুছে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে ওরা। ধুঁকতে থাকা বেশ কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হাল ফিরিয়েছিলাম আমরা, সেই সঙ্গে মিড-ডে মিল চালু করি। জানি না, সেই সমস্ত প্রকল্প চালু আছে কি না!
পুরসভার অব্যবহৃত সম্পদকে কাজে লাগিয়ে পুর আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমরা নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করি। পরিকল্পনা খাতে ব্যয়ের অধিকাংশই আমরা নিজস্ব আয় থেকে করেছি। রাজ্য সরকারের উপরে নির্ভরতা কমই ছিল। দেনা মিটিয়ে অতিরিক্ত ৫০০ কোটি টাকার তহবিল তৈরি করেছিলাম। আজ বিজ্ঞাপনের ঠেলায় সে সবের অপচয় হয়েছে। কাউন্সিলরদের প্রশ্রয়ে গত দশ বছরে শহরে প্রচুর বেআইনি নির্মাণ ও জলাশয় ভরাট হয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। নাগরিকেরা সচেতন না হলে আগামী দিনে আমাদের সকলকেই ভুগতে হবে।
সব শেষে বলি, চটক ছেড়ে পুর পরিষেবার মূল স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে। রাজ্যের মন্ত্রী আর পুরসভার মেয়র একই ব্যক্তি হলে তৃতীয় স্তরের সরকারের যে ধারণা, তা মেনে চলা হয় না। পুরসভার স্বায়ত্বশাসনের অধিকার বর্জন করা হয়।