অবহেলিত: এমনই বেহাল দশা কলেজ স্ট্রিটের ‘বর্ণপরিচয়’ বাজারের। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
চার নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলেই বিবর্ণ ও মলিন এক পরিবেশ। সেখানে পরপর বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার অফিস ও দোকান। আলো-আঁধারির বদ্ধ জায়গায় ঘুরছে পোকামাকড়, উড়ছে মশা। যত্রতত্র পড়ে আছে আবর্জনার স্তূপ। তার মধ্যেই কোনও রকমে চলছে ব্যবসা।
কলেজ স্ট্রিটের ‘বর্ণপরিচয়’ বাজারের এখন এমনই দশা। সেখানে দোকান বা অফিস খুলে বসা প্রকাশকেরা জানালেন, কলেজ স্ট্রিটের সমস্ত প্রকাশনা সংস্থাকে এক ছাতার নীচে আনতেই শুরু হয়েছিল ওই বহুতল তৈরির কাজ। কথা ছিল, শুধু দেশের নয়, এশিয়ার অন্যতম বড় বই বাজার হিসাবে গড়ে তোলা হবে সেটি। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, দোতলাতেই থেমে গিয়েছে নির্মাণকাজ। বাকিটা কবে হবে, বা আদৌ হবে কি না, জানা নেই কারও।
বাজারের ভিতরে ঢুকে দেখা গেল, জঞ্জাল ফেলার জন্য একটি ডাস্টবিনও রাখা হয়নি। সেই কারণে যত্রতত্র স্তূপীকৃত হয়ে রয়েছে আবর্জনা। বুলবুল ইসলাম নামে এক প্রকাশক বললেন, ‘‘দোতলায় ওঠার লিফট নেই। লিফটের জন্য যে জায়গা বরাদ্দ ছিল, সেখানে দেওয়াল তুলে দেওয়া হয়েছে। লিফট না থাকায় প্রবীণ ক্রেতারা উপরে উঠতে পারেন না। র্যাম্প না থাকায় প্রতিবন্ধীরাও সমস্যায় পড়েন।’’ সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে আর এক প্রকাশকের অভিযোগ, ‘‘দোতলায় হাওয়া চলাচলের ব্যবস্থা তেমন না থাকায় প্রায় গুদামঘরের মতো অবস্থা।’’
মৃত্যুঞ্জয় সেন নামে আর এক প্রকাশক বললেন, ‘‘সিলিংয়ের ফাটল থেকে জল চুঁইয়ে পড়ে দেওয়াল ভিজে যাওয়ায় পলেস্তারা খসে পড়ছে।’’ আর এক প্রকাশক আবার জানালেন, নামমাত্র কয়েকটি অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্র রাখা আছে ঠিকই, কিন্তু স্প্রিঙ্কলারের মাধ্যমে জল দেওয়ার ব্যবস্থা ঠিক নেই।
দোতলার শৌচাগারে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে নারকীয় অবস্থা। আশপাশে জল জমে রয়েছে। শৌচাগারে কোনও ডাস্টবিন না থাকায় মেঝেতেই আবর্জনার স্তূপ। সেখানে ছুঁচোর রাজত্ব বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। তাঁরা জানালেন, অসমাপ্ত ওই বহুতলের যত্রতত্র জল জমে থাকায় মশা জন্মাচ্ছে। সৌরভবাবুদের অভিযোগ, পুরসভার কোনও পরিষেবাই সেখানে কার্যত মেলে না। অথচ, ভাড়া দিতে দিনকয়েক দেরি হলেই দোকানের সামনে নোটিস ঝুলিয়ে দেন পুর কর্তৃপক্ষ।
‘পিপিপি’ (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) মডেলে ‘বর্ণপরিচয়’ বাজার তৈরির জন্য ২০০৬ সালে কলকাতা পুরসভা একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। সেই চুক্তির মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেও নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। ব্যবসায়ীরা জানালেন, প্রয়াত তৃণমূল নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় মেয়র থাকাকালীন ওই বাজারটি তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল। সুব্রতবাবুর পরে মেয়র পদে অনেকেই এসেছেন, গিয়েছেন। কিন্তু ‘বর্ণপরিচয়’ রয়ে গিয়েছে সেই তিমিরেই।
ব্যবসায়ীদের একাংশের আবার অভিযোগ, ওই জমিতে যাঁর যতটা জায়গা ছিল, বাজারের ভিতরে সেই অনুযায়ী জায়গা পাননি তাঁরা। ‘কলেজ স্ট্রিট মার্কেট প্রগতিশীল ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি’র কোষাধ্যক্ষ আশিস দাসের অভিযোগ, ‘‘পুরসভা বা নির্মাণকারী সংস্থা, কেউই বাজার সংস্কারে উদ্যোগী হচ্ছে না।’’
যদিও পুরসভার বাজার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত, বিদায়ী প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য আমিরুদ্দিন ববি অভিযোগ খারিজ করে বলেন, ‘‘বর্ণপরিচয় গড়ার জন্য পুরসভা চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল বাম আমলে। তবে তৃণমূল পুরবোর্ডে থাকাকালীনই প্রায় ১২০০ ব্যবসায়ীকে মার্কাস স্কোয়ার থেকে বর্ণপরিচয় বাজারে আনা হয়েছে। তাঁদের জায়গাও আগের অনুপাতেই দেওয়া হয়েছে। গত দু’বছরে করোনার জন্য কাজে দেরি হয়েছে।’’ তবে বাজারের কাজ শেষ করতে না-পারার পুরো দায় নির্মাণ সংস্থার উপরেই চাপিয়েছেন তিনি। আমিরুদ্দিন বলেন, ‘‘কাজ শেষ করতে না পারায় ওই নির্মাণকারী সংস্থাকে বাতিল করতে চাই আমরা। এ বিষয়ে পুর আইন দফতরের কাছে পরামর্শ চাওয়া হয়েছে।’’
এ বিষয়ে প্রশ্ন করতে নির্মাণকারী সংস্থার কর্ণধার সমর নাগকে একাধিক বার ফোন করা হলেও সেটি বেজে গিয়েছে। এসএমএস বা হোয়াটসঅ্যাপ করা হলেও জবাব মেলেনি।