—ফাইল চিত্র।
রবিবার সন্ধ্যায় ঘড়ির কাঁটা সবে ৬টার ঘর ছুঁয়েছে। বাইরে হালকা ঠান্ডা। তার মধ্যেই প্রবল বিক্রমে শব্দবাজি জানিয়ে দিল, আজ কালীপুজো। কলকাতার বাগবাজার, নিউ মার্কেট চত্বর, টালিগঞ্জের বাসিন্দারা জানান, সন্ধ্যার পর থেকেই বাজির শব্দ মিলেছে তাঁদের এলাকায়। এ বারও মহানগরে কালীপুজোর রাতে শব্দবাজির তাণ্ডব মালুম হল বলেই জানাচ্ছেন তাঁরা। দুর্গাপুজোর বিসর্জনের শোভাযাত্রা থেকে শহরের একাধিক জায়গায় শব্দবাজি ফাটানোর যে অভিযোগ উঠেছিল, তা অব্যাহত ছিল লক্ষ্মীপুজোতেও। আশঙ্কা ছিল, কালীপুজোয় মাত্রা ছাড়াবে শব্দ-তাণ্ডব। কিন্তু তার পরেও কেন কড়া পদক্ষেপ করা হল না, সেই প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।
প্রায় প্রতি বছরই কালীপুজোর রাতে শব্দাসুরের তাণ্ডবে অতিষ্ঠ হন শহরবাসী। শব্দবাজি রুখতে প্রশাসন বারবার আশ্বাস দিলেও, লুকিয়ে-চুরিয়ে শব্দবাজি বিক্রি হয়েই থাকে। বাজার ঘুরলেই তা টের পাওয়া যায়। কিন্তু এ বারও শব্দবাজির ভূত দাপিয়ে বেড়াল মহানগর। সন্ধ্যার দিকে বিক্ষিপ্ত ভাবে শব্দবাজির আওয়াজ কানে এলেও দাপট কমই ছিল। অন্তত রবিবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। কিন্তু তার পর থেকেই শহর জুড়ে শুরু শব্দের উপদ্রব। পাটুলির চিকিৎসক দীপক কুণ্ডুর কথায়, ‘‘সন্ধ্যা থেকেই শব্দবাজি ফাটছে। অন্য বছরে কালীপুজোর রাতে বারুদ-ধোঁয়া-কুশায়া মিশে এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি হত। কিন্তু এ বার তেমন কিছু হবে না বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু এখন তো ভয়াবহ অবস্থা।’’
লালবাজার সূত্রের অবশ্য বক্তব্য, অভিযোগ পেলেই তা খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ করা হচ্ছে। সাড়ে ৮টা পর্যন্ত সাড়ে ন’কেজি বাজি আটক করা হয়েছে। গ্রেফতারও করা হয়েছে ২২ জনকে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সূত্রে খবর, রবিবার মোট আটটি বাজি ফাটানোর অভিযোগ এসেছে। তার মধ্যে দু’টি কলকাতা থেকে। বাকি ছ’টি জেলা থেকে এসেছে। সব ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পর্ষদ সূত্র।
এ দিকে, হরিদেবপুর, বাঁশদ্রোণী, গড়িয়া, পর্ণশ্রীর পাশাপাশি বেলগাছিয়া, কাশীপুর, উল্টোডাঙা, ফুলবাগান এলাকায় বিপুল শব্দবাজি ফাটানো হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন বাসিন্দাদের একাংশ। কসবা সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা অনিন্দিতা বসু বললেন, ‘‘সন্ধ্যা থেকে মাঝেমধ্যেই বাজির আওয়াজ হচ্ছে। বাড়ির পোষ্য ভয়ে এ দিক-ও দিক দৌড়োদৌড়ি শুরু করেছে।’’ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রবিবার ১২টা নাগাদ নিউ মার্কেট চত্বরে শব্দের পারদ চড়েছিল ৮৫.৪ ডেসিবেলে। ওই সময় ওই এলাকায় যা থাকার কথা ৬৫ ডেসিবেলের নীচে! কসবা শিল্পাঞ্চলে সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সেখানে শব্দদূষণের মাত্রা থাকা উচিত ৭৫ ডেসিবেল। রবিবার রাত ৮টা নাগাদ কসবায় শব্দের তীব্রতা পৌঁছেছিল ৮০.১ ডেসিবেলে। বাগবাজারের মতো নাগরিক বসত এলাকাতেও রবিবার রাতে শব্দ দূষণের মাত্রা পৌঁছেছে ৮৯.৫ ডেসিবেলে। শহরের হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকাগুলি বরাবরই ‘সাইলেন্স জ়োন’। সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সেই সব এলাকায় শব্দের মাত্রা ৫০ ডেসিবেলের বেশি হওয়ার কথাই নয়। সেখানেও ছন্দপতন ঘটেছে। এসএসকেএস হাসপাতালের কাছে রাত ৮টা নাগাদ শব্দদূষণ ছিল ৫২.২ ডেসিবেল। আরজি কর এলাকায় তা ৬০.৮ ডেসিবেলে পৌঁছে গিয়েছিল।
বহুতল আবাসনের ভিতরে ও ছাদে শব্দবাজি ফাটানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে বেশ কিছু জায়গায়। স্থানীয়দের দাবি, তখন পুলিশের দেখা যাচ্ছে না। প্রশাসনের এই ভূমিকা নিয়েই শহরের সচেতন নাগরিকদের পাশাপাশি পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা প্রশ্ন তুলেছেন। যদিও লালবাজার সূত্রে খবর, শব্দ-তাণ্ডব রুখতে সব রকম ভাবেই প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। প্রায় পাঁচ হাজার পুলিশকর্মী নেমেছেন শহর পাহারা দিতে। থাকছেন ডিসি এবং এসি পদমর্যাদার প্রায় ৫৬ জন অফিসার। রবিবার সকাল থেকেই নিয়ম মানাতে কড়া হাতে পদক্ষেপেরও হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন তাঁরা। শনিবারও এ নিয়ে তাঁদের তৎপরতায় কমতি ছিল না। অতীতের কয়েক বছরের চ্যালেঞ্জকে মাথায় রেখে এ বার আলাদা করে শহরের বহুতলগুলিতে বাড়তি নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে। লালবাজার সূত্রের খবর, শনিবার রাত থেকেই চিহ্নিত কিছু বহুতলের ছাদে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। শুক্র এবং শনিবার বিভিন্ন আবাসন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ নিয়ে বৈঠকও করেছে পুলিশ। যখন-তখন বাজি না ফাটানো এবং ছাদে ওঠার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের কথা জানানো হয়েছে তাঁদের। এলাকায় কতগুলি বসত বহুতল রয়েছে, তার তালিকা তৈরি করে সেগুলিতে বাজি ফাটানোর জন্য আলাদা জায়গা চিহ্নিত করা রয়েছে কি না, তা-ও নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে থানার ওসি-দের। কিন্তু তা সত্ত্বেও দক্ষিণ কলকাতার একটি থানার এক পুলিশ আধিকারিকের মন্তব্য, ‘‘এলাকায় যত আবাসন রয়েছে, সব ক’টির ছাদে নজর রাখতে হলে সেনাবাহিনী নামাতে হয়! পুলিশে এত লোক কোথায়? একটি ছাদে কারা বাজি ফাটিয়েছে, সেখানে উঠে তা ধরতে ধরতেই আর একটি ছাদে বাজি ফাটানো শুরু হয়ে যায়!’’