প্রতীকী ছবি।
গত দেড় মাসে কলকাতা পুলিশে দায়ের হওয়া অভিযোগের প্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে, উৎসবের মরসুমে প্রসাধনী সামগ্রী বিক্রির নামে প্রতারণার থেকেও মানুষ বেশি প্রতারিত হয়েছেন চাকরির টোপে পা দিয়ে। যে চিত্রটা অন্যান্য বছরের থেকে আলাদা। পুলিশের বড় কর্তারা মনে করছেন, করোনা কালে অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়ায় চাকরি দেওয়ার টোপ দিচ্ছে প্রতারণাচক্রের পাণ্ডারা।
পুলিশ সূত্রের খবর, প্রতারণার হাতিয়ার হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে প্রসাধনী সামগ্রী। তৃতীয় এবং চতুর্থ স্থানে যথাক্রমে বন্ধুত্ব পাতানোর নামে প্রতারণা এবং ভ্রমণ! তদন্তকারীদের বক্তব্য, সাইবার অপরাধের তালিকায় শেষ দু’টি প্রতারণা কয়েক বছর ধরে বাড়লেও উৎসবের মরসুমে এর বাড়বাড়ন্ত করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিকেই ইঙ্গিত করছে।
পুলিশি তদন্তে অভিযুক্তের মন বোঝার কাজ করা মনোরোগ চিকিৎসকেরা বলছেন, “সময় এবং সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গেই বদলায় প্রতারণার কৌশল। সাড়ে সাত মাসের লকডাউনে মানুষ যেমন চাকরি হারিয়েছেন, তেমনই বেড়েছে একাকিত্ব। দুইয়ের প্রভাবে চাকরি খুঁজতে গিয়ে কিংবা অনলাইনে বা অন্য ভাবে বন্ধু খুঁজতে গিয়ে প্রতারণা বেড়েছে।”
লালবাজার যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার এক পুলিশ আধিকারিক আবার বললেন, “আনলক-পর্বের শুরু থেকেই প্রতারণার বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে ভ্রমণ। দুর্গোৎসবের পরে গত ১৫ দিনে জমা পড়া অভিযোগের ৭৫ শতাংশই ভ্রমণ সংক্রান্ত। ঘরবন্দি মানুষ ভ্রমণের জন্য অনলাইনে খোঁজাখুঁজি বাড়াতেই যা লাফিয়ে বাড়ছে।”
করোনার কারণে এখন থানার পাশাপাশি অনলাইনেও প্রচুর অভিযোগ জমা পড়ছে পুলিশের কাছে। তাদের হিসেব, অক্টোবরের ২২ তারিখ ষষ্ঠীর দিন থেকে চলতি মাসের ২২ তারিখ পর্যন্ত প্রতারণার অভিযোগ জমা পড়েছে ন’শোর কাছাকাছি। যার মধ্যে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নাম করে প্রতারিত হয়েছেন বলে ৪৮৭ জন অভিযোগ করেছেন।
প্রসাধনী দ্রব্য বিক্রি করার নাম করে অন্তত ২০০টি প্রতারণার অভিযোগ দায়ের হয়েছে। বন্ধুত্ব পাতানোর ফাঁদে প্রতারিত হয়েছেন ১১৩ জন। ভ্রমণের নামে প্রতারিত হয়েছেন একশোর কাছাকাছি ব্যক্তি।
যা অন্য বারের উৎসবের মরসুমের থেকে আলাদা। লালবাজার সূত্রের খবর, গত বছর পুজোর সময়ে এর অর্ধেক সংখ্যকও প্রতারণার অভিযোগ দায়ের হয়নি। যে ক’টি অভিযোগ এসেছিল তা মূলত ছিল প্রসাধনী সামগ্রী বিক্রি এবং ভ্রমণের নামে।
তারাতলার বাসিন্দা এক প্রতারিত বললেন, “গত বছর আমার জেঠিমা পুজোর পরে আগ্রা-বৃন্দাবন যাবেন বলে এক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। পেনশন থেকে জমানো ১৫ হাজার টাকা দিয়ে দেওয়ার পরে তিনি জানতে পারেন, সংস্থাটিই ভুয়ো। এ বার আমার মেয়ে প্রতারিত হয়েছে। নিজে একটি সংস্থায় কাজের পাশাপাশি অভিনয় জগতে কিছু করার চেষ্টা করছে ও। এক বিখ্যাত পরিচালকের অধীনে কাজ দেওয়ার নাম করে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা ওর থেকে নিয়ে নেওয়া হয়েছে।” দত্তপুকুরের আর এক বাসিন্দা আবার বললেন, “পাঁচ নম্বর সেক্টরে চাকরি করতাম। লকডাউনের পরে বলে দিয়েছে আসতে হবে না। কাজ খুঁজতে গিয়ে অনলাইনে চাঁদনি চক এলাকার এক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তারা বলল, দীপাবলির আগে বৈদ্যুতিন যন্ত্রের বিক্রি বাড়ে। সে জন্য তাদের সংস্থায় লোক লাগবে। সাত হাজার টাকা জমার নাম করে ফর্ম পূরণ করাল। গিয়ে দেখলাম, ওই নামের কোনও সংস্থাই নেই! বৌবাজার থানায় লিখিত ভাবে অভিযোগ জানিয়েছি।”
ইন্ডিয়ান স্কুল অব এথিক্যাল হ্যাকিং-এর অধিকর্তা সন্দীপ সেনগুপ্ত বলছেন, “শহরে বহু জায়গায় ব্যবসায়িক স্পেস ভাড়া পাওয়া যায়। তা ভাড়া নিয়ে ছেলেমেয়েদের ডেকে বন্ড জমা করার নামে মোটা টাকা হাতিয়ে চম্পট দেওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। অনলাইনে বেশির ভাগ প্রতারণা যে হেতু প্রক্সি সার্ভারের মাধ্যমে হয়, তাই ধরা মুশকিল। চাকরির আবেদনকারী বা গ্রাহক সতর্ক না হলে, এই প্রতারণা আটকানো কঠিন।” পুলিশের বড় কর্তারাও বলছেন, “অভিযোগ খতিয়ে দেখে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে ঠিকই, তবে গ্রাহকদেরও সতর্ক হতে হবে। সেটাই প্রতারণা রোখার সব থেকে বড় পথ।”