এক তরুণীকে নেশামুক্তি কেন্দ্রের গাড়িতে জোর করে তোলে পুলিশ। প্রতীকী ছবি।
যাদবপুর থানার সামনে বড় জটলা। থানা থেকে ভেসে আসছে এক তরুণীর চিৎকার। একটি ভিডিয়োয় ধরা এই দৃশ্যের কিছু ক্ষণ বাদেই দেখা যাচ্ছে, সেই তরুণীকে টেনে হিঁচড়ে বার করা হচ্ছে। এর পরে একটি গাড়িতে জোর করে তোলা হচ্ছে তাঁকে। তরুণীকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে পারেন যাঁরা, তাঁদের দূরে আটকে রাখতে পুলিশ কার্যত গাড়িটি ঘিরে রেখেছে। তারই মধ্যে ওই তরুণী বলে চলেছেন, ‘‘এ ভাবে কিন্তু কাউকে নিয়ে যাওয়া যায় না। আমি প্রাপ্তবয়স্ক।’’
কোনও অভিযুক্তকে পুলিশের গাড়িতে তোলার দৃশ্য এটা নয়। অভিযোগ, এ হল এক তরুণীকে নেশামুক্তি কেন্দ্রের গাড়িতে তোলার দৃশ্য। একাধিক ভিডিয়োয় তুলে রাখা এমনই কয়েকটি দৃশ্য দেখিয়ে নিজেকে ওই তরুণীর প্রেমিক বলে দাবি করেন ঋতব্রত ঘোষ নামে বছর ছত্রিশের এক যুবক। রবিবার তিনি বললেন, ‘‘আমার প্রেমিকা তার বাবা-মায়ের বিরুদ্ধেই অভিযোগ করতে এ দিন থানায় গিয়েছিল। ভয় ছিল, ওর বাবা-মা ওকে নেশামুক্তি কেন্দ্রে ভর্তি করিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু পুলিশ নিজেই বাবা-মায়ের কথা মতো ওর অমতে নেশামুক্তি কেন্দ্রের গাড়িতে ওকে তুলে দিল!’’
এ দিকে যাদবপুর থানার পুলিশের দাবি, আইন মেনেই যা করার করা হয়েছে। অভিযোগ থাকলে যে কেউ আইনের দ্বারস্থ হতে পারেন। অধিকার রক্ষা নিয়ে আন্দোলনকারী একাধিক সংগঠন পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা এমন অভিযোগের নিন্দা করেছে। এর প্রতিবাদে আজ, সোমবার বিকেল চারটে নাগাদ যাদবপুর থানার সামনে জমায়েতের ডাক দিয়েছে একটি সংগঠন। সংগঠনগুলির দাবি, এমনই একটি ঘটনায় গত বছরও এই থানার পুলিশের একই ভূমিকা দেখা গিয়েছিল। সেই সময়ে মেয়ের ‘লিভ ইন’ সঙ্গীকে পছন্দ নয় বলে মেয়েকে জোর করে নেশামুক্তি কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে এক মায়ের বিরুদ্ধে। থানা-পুলিশ করেও সুরাহা না পেয়ে সঙ্গীকে কাছে পেতে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন রঞ্জন নাথ নামে এক যুবক। যদিও পরে আদালতে একটি কাগজ জমা দেন সেই তরুণীর মায়ের আইনজীবী। তাতে তরুণী লেখেন,রঞ্জনের সঙ্গে তিনি থাকতে চান না। তাঁর ভালই চিকিৎসা চলছে। এর পরে আর মামলাটি টেকেনি।
ঋতব্রত নামের এই যুবকের সঙ্গে বছর ছাব্বিশের ওই তরুণীর পরিচয় যশোর রোডের ‘গাছ বাঁচাওকমিটি’র কাজের সূত্রে। ২০১৭ সাল থেকে তাঁরা একসঙ্গে থাকতে শুরু করেন। বর্তমানে যাদবপুরের বিক্রমগড়ে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকছিলেন তাঁরা। দু’জনেই পশ্চিমবঙ্গ গণ-সমবায় উদ্যোগে কাজ করেন। তরুণীর বাড়ি হাবড়ারশ্রীপুরে। সেখানে তাঁদের পারিবারিক সোনার দোকান রয়েছে। ঋতব্রত থাকেন দেগঙ্গায়। তাঁর বাবা অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক।
ঋতব্রতের দাবি, তাঁর সঙ্গী ‘অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভ ডিজ়অর্ডার’-এ (এডিএইচডি) আক্রান্ত। তার চিকিৎসাও চলছে। এখন এইরোগটিকেই হাতিয়ার করা হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘গত কয়েক দিন ধরেই বিয়ে দেওয়ার জন্য জোর করা হচ্ছিল ওকে। বিয়ে নামক প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরোধী আমরা। সেই কারণেই জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’’
তরুণীর বাবা বলেন, ‘‘মেয়েকে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় পাঠিয়েছিলাম। এই মুহূর্তে আমাদের মেয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে মানসিক রোগে ভুগছে। ওর চিকিৎসার জন্যই নিয়ে এসেছি।’’
মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব বলছেন, ‘‘তরুণী যদি সত্যিই নেশাগ্রস্ত হন, তা হলেইনেশামুক্তি কেন্দ্রে তাঁকে নিয়ে যাওয়ার কথা। আর তা যদি না হয়ে থাকেন, তা হলে নেশামুক্তি কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়াটা অপরাধ। মানসিকরোগীকে নেশামুক্তি কেন্দ্রে রাখা যায় না। আরও একটি বিষয়, কোনও প্রাপ্তবয়স্ক নিজের দায়িত্ব নিতে অপারগ, এমনটাকেউ প্রমাণ করলে এবং তাঁর আইনি অভিভাবকত্ব কেউ প্রমাণ করতে পারলেই তাঁকে নিয়ে যাওয়াযায়। অন্যথায় আইনবিরুদ্ধকাজ হিসাবেই বিষয়টিকে ধরেনেওয়া হয়।’’