গত কয়েক বছরে এমন দৃশ্য খুব একটা দেখা যায়নি। বিচার-ভবনের এজলাস থেকে বেরোতেই তদন্তকারী অফিসার তথা লালবাজারের উইমেন্স গ্রিভ্যান্স সেলের ওসি গৌরী মুখোপাধ্যায়কে ঘিরে ধরেছেন চেনা পুলিশকর্মী-আইনজীবীরা। প্রত্যেকেরই মুখ খুশিতে উজ্জ্বল। সাধারণত চুপচাপ গৌরীদেবীকেও কদাচ এমন ফুরফুরে মেজাজে দেখা যায়। খুব কাছেই দাঁড়িয়ে এক অফিসার বলছিলেন, ‘‘যাক্, অনেক দিন বাদে পুলিশের খানিকটা মুখরক্ষা হল!’’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় নানা ঘটনায় পুলিশের যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠতে দেখা গিয়েছে, তাতে এই উচ্ছ্বাস বাড়াবাড়ি বলা যাচ্ছে না। শাসক দলের নেতাদের সামনে পুলিশের নতি স্বীকার যেন এ রাজ্যে দস্তুর হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার দুপুরে বিচার-ভবনে পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ-কাণ্ডের রায় পুলিশকে খানিকটা শাপমুক্তির স্বাদ এনে দিচ্ছে বলেই মনে করছেন লালবাজারের অফিসারদের একাংশ।
পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ-কাণ্ডে পুলিশের কাজটা যে সহজ ছিল না, তা মানছেন লালবাজারেরই একটা বড় অংশ। তদন্ত শুরু হতে না-হতেই স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একে ‘সাজানো ঘটনা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার পরেই অভিযোগকারী মহিলা সুজেট জর্ডনকে নানা ভাবে কটাক্ষ করতে থাকেন রাজ্যের শাসক দলের একাধিক নেতা-মন্ত্রী-সাংসদ। তৎকালীন পুলিশ কমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দাও সেই সুরে সুর মিলিয়েই বলেছিলেন, সংবাদমাধ্যম অহেতুক সরকারপক্ষের নামে কুৎসা রটাচ্ছে! আর এ সবের মিলিত ধাক্কায় চিড় ধরতে শুরু করেছিল তদন্তকারীদের মনোবলে। কিন্তু তার পরেও প্রতিকূলতার পাহাড় টপকে ধৃতদের বিরুদ্ধে যথাযথ মামলা সাজিয়েছিল পুলিশ। যার নিট ফল, আদালতে এই মামলায় মুখ পুড়ল না লালবাজারের!
তবে এটাও ঠিক, পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ-কাণ্ডে সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতাও রয়েছে পুলিশের। ঘটনার তিন বছর দশ মাস পরেও মূল অভিযুক্ত কাদের খান অধরাই। তবু পুলিশ যেটুকু পেরেছে, তারই সূত্র ধরে ফের সামনে উঠে আসছে লালবাজারের প্রাক্তন গোয়েন্দাপ্রধান দময়ন্তী সেনের নাম। এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডে দময়ন্তীর নেতৃত্বেই তদন্তের আসল কাজটা হয়ে গিয়েছিল। গোড়ায় নানা বিভ্রান্তি ছড়ালেও উনি (দময়ন্তী) মাথা ঠান্ডা রেখে টিমকে নেতৃত্ব দেন। তাঁর দেখানো পথেই দোষীদের চিহ্নিতও করা হয়। তা না-হলে তদন্তে কিছু বেরতো বলে মনে হয় না।’’
যাঁর জন্য লালবাজারের এই ‘সাফল্য’, তাঁকে অবশ্য বেশ দাম দিতে হয়েছিল গোড়ার দিকে। মুখ্যমন্ত্রীর ‘সাজানো ঘটনা’র তত্ত্বকে কার্যত মিথ্যে প্রমাণ করার পরেই দময়ন্তীকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বের পদে বদলি করে দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁর দেখানো পথে পুলিশি তদন্তের অভিমুখ আর বদলানো যায়নি। প্রভাবশালীদের ‘চাপে’র মুখে পুলিশের এই অটল থাকার নজিরই এখন এ রাজ্যে ব্যতিক্রমী ঘটনা বলে চিহ্নিত হচ্ছে।
পড়ুন: কুৎসা সত্ত্বেও জানতাম, সত্যিটা বেরোবে
পান্ডা অধরাই, পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণে দোষী ৩
এমন সময় সুজেটই নেই! খুব আফসোস হচ্ছে
কারণ, গত কয়েক বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশকে বারেবারেই ‘অন্য ভূমিকায়’ দেখতে এক রকম অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন রাজ্যবাসী। শাসক দলের কথায় ওঠবোস করার অভিযোগ অবশ্য এ রাজ্যের পুলিশের বিরুদ্ধে নতুন নয়। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তারাই পুলিশকে নিজেদের সুবিধেমতো কাজে লাগায় বলে অভিযোগ। কিন্তু ২০১১ সালে রাজ্যে শাসন ক্ষমতায় পরিবর্তনের পরে পুলিশকে বারেবারে বিরল ভাবে অপদস্থ হতে দেখা গিয়েছে। কখনও গার্ডেনরিচে শাসক দলের ছেলেদের হাতে সাব-ইনস্পেক্টর খুনের পরেও অভিযুক্ত নেতা কিছু দিন জেল খেটে ফের স্বমহিমায়! কখনও স্থানীয় তৃণমূল নেতা প্রতাপ সাহার দাপটে আলিপুর থানার পুলিশ টেবিলের তলায়! আবার কলকাতার মেয়রের ভাইঝির হাতে ট্রাফিক পুলিশ নিগ্রহের পরেও চুপ লালবাজার! এ ছাড়াও গত সাড়ে চার বছরে অসংখ্য বার শাসক দলের চুনোপুঁটি নেতারাও পুলিশকে ধমকেছেন অবলীলায়। যার জেরে এ রাজ্যের পুলিশের সিংহ ভাগের মেরুদণ্ডহীনতার ছবিটাই জনমানসে জেঁকে বসেছে। আজকের সাফল্য তাই লালবাজারের অনেকের কাছেই ‘শাপমোচন’!
পুলিশকর্তারা অবশ্য স্বাভাবিক ভাবেই এ নিয়ে আলোচনায় ঢুকতে চাইছেন না। দময়ন্তী নিজেও মুখে কুলুপ এঁটেছেন। এ দিন রায় বেরনোর পরেও তিনি পারতপক্ষে সাংবাদিকদের ফোন ধরেননি। বর্তমানে রাজ্য পুলিশের আইজি (সংগঠন) দময়ন্তী সেনের সঙ্গে ভবানীভবনে দেখা করতে গেলেও তিনি মিটিংয়ে ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে এড়িয়ে গিয়েছেন। তাঁর সহকর্মীরা অনেকেই বলছেন, পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রীর ‘সাজানো ঘটনার তত্ত্ব’কে কার্যত মিথ্যে প্রমাণ করে মুখ্যমন্ত্রীর বিরাগভাজন হয়েছিলেন গোয়েন্দাপ্রধান। যার জেরে তিনি এখন আরও সতর্ক। নিরুপায় না-হলে সাধারণ কোনও বিষয়
নিয়েও সংবাদমাধ্যমে সচরাচর মুখ খোলেন না তিনি।
বর্তমানে পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডের তদন্তে তাঁর কোনও যোগ না-থাকলেও দিনভর ঘুরে-ফিরে লালবাজারে, ভবানীভবনে পুলিশকর্মীদের মুখে কেবল দময়ন্তীরই নাম। পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষিতা সুজেট জর্ডন দময়ন্তীকে ‘বাঘিনী’ বলেছিলেন। তাঁর আইনজীবী অনির্বান গুহঠাকুরতাও এ দিন বলছিলেন, ‘‘ম্যাডামের (দময়ন্তী) সঙ্গে কথা বলে সুজেট দারুণ ভরসা পেয়েছিল। এই তদন্তের জন্য পুলিশের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।’’
লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের এক পোড়খাওয়া অফিসার বলছিলেন, পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডের পরেই শাসক দলের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়াটা ওঁর পক্ষে খুব সহনীয় ছিল না। তাঁর কথায়, ‘‘লালবাজারে ম্যাডামের (দময়ন্তী) বিদায়-সম্বর্ধনার আসরেও সবার মনেই ঝড় বইছিল। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছিলাম না। উনিও কিছু বলেননি। শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলেন।’’ সে-দিন দময়ন্তী গেয়েছিলেন, ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’! নিম্ন আদালতের রায়ে পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডে প্রথম ধাপের যুদ্ধজয়ের পরে অনেক দিন বাদে পুলিশকর্মীরাও যেন সার্থকতার স্বাদই পেলেন!