পথের দাবি: নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের পরে প্রতিবাদে শহরের রাজপথে বিশিষ্টজনেরা। ফাইল চিত্র
“সে ছিল এক দিন আমাদের...”— যখন শিল্পীরা দৃঢ় ভাষায় প্রতিবাদ করতেন! আর এখন? তাঁরা ‘সেফ’ খেলেন, ‘মাঠে’ নামেন না। নিরপেক্ষতার নামে গা বাঁচিয়ে চলেন।
আজকের বিপুল প্রযুক্তি ও গণমাধ্যমের মারপ্যাঁচ তখন ছিল না, এবং এটা মাথায় না-রাখায় তৈরি হয়েছে এই ভ্রান্ত ধারণা। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্সরশিপ নিয়ে গবেষণা করার সময়ে এইটুকু শিখেছি যে, সোশ্যাল মিডিয়া ও ‘ক্যানসেল কালচার’-এর যুগে শিল্পীর মত প্রকাশ মানেই অনলাইন-কাঠগড়ায় দাঁড়ানো। কাঠগড়া কখনওই কাঙ্ক্ষিত মঞ্চ হতে পারে না। স্বাস্থ্য পরীক্ষাও হয় এই কাঠগড়ায়। যেমন ধরুন, এক শিল্পীর শিরদাঁড়া আছে, কি না। এটা চিরসত্য যে, শিল্পীরা মূল্যায়নের ঊর্ধ্বে নন। সমস্যাটা সমালোচনায় নয়, সমালোচনার ধরন, মাধ্যম এবং তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে।
ইন্টারনেট-যুগের আগেও শিল্পীরা তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ফাঁদে পড়েছেন। মনে পড়ে সলমন রুশদির কথা। তাঁর সাহিত্যের স্তরবিন্যাস এবং ভাষার অসাধারণ যুগলবন্দি আজ পিছনের আসনে। রুশদি বললেই সবার মাথায় আসে ‘দ্য সেটানিক ভার্সেস’কে ঘিরে দীর্ঘ বিবাদ, পোড়া বইয়ের গন্ধ, খুনোখুনি। সবটাই পাঁচশো পাতার উপন্যাসের মাত্র ১১টি পাতার দৌলতে। গবেষণা করতে গিয়ে জানতে পারি, কিছু ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠন বইটির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ফ্যাক্স, চিঠি এবং বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের উপরে চাপ সৃষ্টি করেছিল। ১৯৮৯ সালে তাঁর নামে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছিলেন তৎকালীন ইরানের আয়াতোল্লা রুহোল্লা খোমেইনি। বাক্-স্বাধীনতার কবর খুঁড়েছিল সেই ঘটনা।
চিঠির বিলম্বে আগমন, বা ফ্যাক্সের গোপনীয়তা আর নেই। অনলাইন কাঠগড়ায় একসঙ্গে প্রশ্ন করছেন হাজার হাজার আইনবোদ্ধা। না-আছে নির্বাচনের উপায়, না-আছে আইনের আড়াল। চলছে মস্ত বড় ক্রিকেট ম্যাচ। দ্বাদশ ব্যক্তি ছাড়াও ‘মাঠে’ নেমে পড়েন অনামা ক্রীড়াবিদ। যে কেউ যখন-তখন বল করতে পারেন— সে ডিউস বল হোক, বা পচা টোম্যাটো। কারও মন চাইলে কাশ্মিরী উইলো ব্যাট নিয়ে আপনাকে তাড়াও করতে পারেন। গায়ে লাগবে না, কিন্তু ‘গায়ে’ লাগবে। জাজ নেই, আম্পায়ার নেই, রেফারি নেই। আছে শুধু নেটিজেন, শব্দের অস্ত্র আঙুলেই।
তবে এই অনলাইন খেলাকে শুধুই বদনাম করা মানে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া। শিল্পীর সৃষ্টির প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার এখন এই মাধ্যম। জট বাধে তখন, যখন আত্মনিয়ন্ত্রিত ওয়েব-ব্যক্তিত্ব তৈরির প্রশ্ন ওঠে। ধিক্কার জানালে বা সহমত হলে, শিল্পী চান বা না-চান, রব উঠবে, ‘উনি এই পক্ষে!’ নিস্তব্ধতাও ক্রমশ জটিল হয়ে উঠেছে। সে ক্ষেত্রে নেট-ডাক্তাররা আবার মেরুদণ্ডহীনতার দুঃসংবাদ দেবেন। ভিন্ন মানসিকতার বিচারে তাঁদের কথার ব্যাখ্যা হতে দেখে শিল্পীদের মোহভঙ্গ, ভীতি বা রাগ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হলে প্রশ্নের শিকার হওয়াটাই তো বাঞ্ছনীয়! এবং ফলও পাওয়া যায়— ছোটবেলার হিরো শক্তিমান দেখলেন যে নারীবিদ্বেষী কথা বললে তাঁর ডানা কেটে দেওয়া হবেই। সবাই ‘পদ্মাবৎ’-এর ডিভোর্সড ‘আই’ অক্ষরটির সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে হাসছেন আজও।
জনমাধ্যমে কাটাছেঁড়ার ফলে সচেতন মানুষ প্রতিবাদের ঢেউ তুলেছেন বার বার। কিন্তু অশোভন, আপত্তিকর দাবি ছাড়াও, অধিকাংশ শিল্পীদের অভিব্যক্তির নিজস্ব সবুজ-মেরুন, লাল-হলুদ, সাদা-কালো রং একান্ত জায়গা থেকে আসে। সেটিকে সুস্থ ও রুচিসম্পন্ন ভাষায়-বিতর্কে চ্যালেঞ্জ করাই যায়। তবে কি-প্যাডের চারটি বোতাম টিপে তাঁদের নগ্ন করার প্রবণতা, শুধু সেলিব্রিটি নয়, মানুষের প্রতিই অমর্যাদা।
এখন রুশদি নিউ ইয়র্কে হাসপাতালের বিছানায় সঙ্কটজনক অবস্থায়। ফতোয়ার আহ্বানে অন্তত দশ বার ছুরির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত। রুশদির আক্রমণকারী হাদি মাটারের ব্যাপারে পুলিশি তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্তকারীরা কাটাছেঁড়া করে বিশ্লেষণ করছেন, তার সোশ্যাল মিডিয়ার একের পর এক পোস্ট। তার ফোনে পাওয়া গিয়েছে ইরান-বিরোধীদের মৃতদেহের ছবি এবং রুশদির টুইট-এর প্রত্যুত্তরে তাঁকে অজস্র মৃত্যুর হুমকি। রুশদি হয়তো সেগুলো অবসর সময় পড়েওছিলেন। ফতোয়ার পরে তিরিশ বছর কেটে গিয়েছে বলে তাঁর মৃত্যুভয় আংশিক ভাবে বিলীনও হয়ে গিয়েছিল বোধহয়!
এই ঘটনার পরেও যথারীতি অনেকেই গালিগালাজ-প্রুফ জ্যাকেট পরে নিজের মতামত বা প্রবন্ধ লিখে ফেসবুক-টুইটারে স্পষ্ট জানাবেন। অন্য কেউ নিজের সিনেমা, গান, কবিতা বা আঁকার মাধ্যমে রুখে দাঁড়াবেন। উভয় পক্ষের থেকেই আমার অনেক শেখার আছে। এখনও খেলাটা বুঝছি দর্শকাসন থেকেই। মাঠে নামার সিঁড়ির প্রথম ধাপে দাঁড়িয়ে। ধর্মান্ধতা এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিন ছাত্রের গল্প নিয়ে আসতে চলেছে আমার দ্বিতীয় ছবি। আমি চাই, এখানে আমার চরিত্রের মতোই নিজের জীবনে রুচিশীল সমালোচনা গ্রহণ করা, বক্তব্য রাখার আগে ভাবা এবং নিজেকে প্রশ্ন করার প্রবণতাকে জিইয়ে রাখা। ভয়ানক কাঠগড়া-কাঠগড়া খেলা এটাই আমাকে শিখিয়ে দিয়েছে।
আমার জেনারেশনের শিল্পীদের উপরে সম্পূর্ণ আস্থা আছে। বিশ্বাস করি, মত প্রকাশের সুযোগ বেছে তাঁরা তাঁদের মতের মান বাড়াবেন, এবং প্রকাশ করবেন স্বনির্বাচিত আঙ্গিকে, মাধ্যমে, মনস্কে।