সুসজ্জিত: উদ্বোধনের অপেক্ষায় নতুন মাঝেরহাট সেতু। বুধবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
আজ, বৃহস্পতিবার থেকে চালু হচ্ছে নতুন মাঝেরহাট সেতু। দু’বছর তিন মাস পরে ফের সেতু দিয়ে যাতায়াত শুরু হলে সব থেকে বেশি লাভবান হবেন দক্ষিণ শহরতলির মানুষ। যান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে আসার অপেক্ষায় কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশও।
লালবাজার সূত্রের খবর, নতুন সেতুতে থাকছে বিশেষ ধরনের সেন্সর। যার মাধ্যমে জানা যাবে সেতুর উপরে কত ওজন রয়েছে। নির্দিষ্ট ওজন পেরোলেই অ্যালার্ম বাজবে, যা শুনে যান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে সক্রিয় হবে লালবাজার। সেতুর উপরে নজরদারি চালানোর জন্য সিসি ক্যামেরা লাগানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সূত্রের খবর, খুব শীঘ্রই আটটি ক্যামেরা বসানো হবে সেতুতে। এ ছাড়া ভেঙে পড়ার আগে পর্যন্ত যে ভাবে সেতু দিয়ে গাড়ি চলাচল করত, যান নিয়ন্ত্রণে সেই একই ব্যবস্থা থাকছে।
২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর আচমকা ওই সেতু বিপর্যয়ের ফলে তালগোল পাকিয়ে যায় দক্ষিণ কলকাতার যান চলাচল ব্যবস্থা। ওই সেতু দিয়েই বেহালা, ঠাকুরপুকুর, জোকা, পর্ণশ্রী-সহ বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ যাতায়াত করতেন। সেই সময়ে দুর্গাপুর ব্রিজের উপরে গাড়ির চাপ অত্যধিক পড়তে থাকায় নিউ আলিপুর এবং আলিপুরে সারা দিন গাড়ির দীর্ঘ লাইন দেখা যেত।
সেতুবন্ধনের ইতিকথা
• ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮: বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল সেতু। মৃত তিন, আহত ২৫।
• সেপ্টেম্বর, ২০১৮: দিন কয়েকের মধ্যেই ভগ্ন সেতুর বাকি অংশ ভাঙা শুরু পূর্ত দফতরের।
• সেপ্টেম্বর, ২০১৮: রাজ্য সিদ্ধান্ত নেয় ধনুকের মতো স্টিল গার্ডারের সেতু হবে।
• অক্টোবর, ২০১৮: মাঝেরহাট সেতুর বিকল্প পথ হিসেবে পুজোর মধ্যেই খুলে দেওয়া হয় দু’টি বেলি ব্রিজ ও লেভেল ক্রসিংয়ের রাস্তা।
• জানুয়ারি ২০১৯: সিদ্ধান্ত বদলে কেব্ল স্টেড সেতু তৈরির ঘোষণা রাজ্যের।
• জানুয়ারি ২০১৯: নির্মীয়মাণ জোকা-বি বা দী বাগ মেট্রোর কারণে রাজ্য ও মেট্রোর মধ্যে সেতুর নকশা নিয়ে মতানৈক্য।
• মার্চ-এপ্রিল ২০১৯: রাজ্যের পাঠানো নকশার ২৯টি ত্রুটি দেখাল রেল।
• জুলাই, ২০১৯: অবশেষে নকশা দেখে সন্তুষ্ট হয় বিদেশি পরামর্শদাতা সংস্থা এবং রেল। নকশা চূড়ান্ত হল।
• জুলাই ’১৯–জানুয়ারি ’২০: সেতুর লঞ্চিং গার্ডার ও বেয়ারিং সংক্রান্ত জটিলতা চলতে থাকে।
• জানুয়ারি, ২০২০: শুরু হল নয়া সেতুর নির্মাণ-পর্ব।
• ফেব্রুয়ারি, ২০২০: সামগ্রিক পরিকল্পনা দেখে সেতু তৈরির ছাড়পত্র দেয় রেলওয়ে সেফটি কমিশনার।
• এপ্রিল, ২০২০: লকডাউনে বন্ধ কাজ।
• জুন, ২০২০: ফের পুরোদমে রাতদিন এক করে শুরু হয় কাজ।
• অক্টোবর, ২০২০: ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে মাঝেরহাট সেতুর নির্মাণ শেষের ঘোষণা।
• ২৫ নভেম্বর, ২০২০: ৩৮৫ টন ভার বহনে সক্ষম সেতুর নির্মাণ শেষে তিন ধাপে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় পাশের ফলাফল ঘোষণা।
• ২৭ নভেম্বর, ২০২০: ‘সেতু ব্যবহারের উপযুক্ত’— ছাড়পত্র রেলওয়ে সেফটি কমিশনারের।
অবস্থা সামাল দিতে পুলিশ প্রথমে বেলি ব্রিজ এবং পরে বিভিন্ন অলিগলি ব্যবহারের উপরে জোর দেয়। মাঝেরহাট সেতু সংলগ্ন রাস্তায় গাড়ির গতি ঠিক রাখতে তখন একাধিক অফিসারকে সেখানে দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়। বন্দরের বিভিন্ন রাস্তা সারাই করা হয়। অব্যবহৃত কিছু রাস্তা দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা হয়। ২০১৯-এর প্রথম দিকে চেতলা সেতু বন্ধ হাতেই ফের যানজটের দুর্বিষহ অবস্থা শুরু হয় টালিগঞ্জ, আলিপুর, নিউ আলিপুর, চেতলা এলাকায়। যার রেশ পড়ে দক্ষিণের আরও কিছু রাস্তায়। লালবাজার সূত্রের খবর, সেই দিক দেখতে পাঠানো হয় অতিরিক্ত বাহিনী। পাশাপাশি টালিগঞ্জে আদিগঙ্গার উপরে তৈরি হয় একটি সেতু। ট্র্যাফিক পুলিশের এক কর্তা জানাচ্ছেন, মাঝেরহাট সেতুর বিভিন্ন বিকল্প রাস্তা খুলে দিয়ে সেখানে অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করে দেওয়া হয়েছিল শুরু থেকেই। তাতেই অবস্থা অনুকূল হয় বলে তাঁর দাবি।
মাঝেরহাট সেতু বিপর্যয়ের পরে। ফাইল চিত্র
সেতু বিপর্যয়ের প্রথম দিকে সমস্যা হলেও অতিরিক্ত ট্র্যাফিক পুলিশ মোতায়েন করে ও পরিস্থিতি বিচার করে আধিকারিকদের দ্রুত সিদ্ধান্ত বদলের জোরেই তা সামাল দেওয়া গিয়েছিল। সেই সঙ্গে পরিবহণ দফতরের গৃহীত একাধিক ব্যবস্থাও যানজটের সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণে কার্যকর হয়। বুধবার ওই এলাকায় ডিউটি করা একাধিক ট্র্যাফিক পুলিশ অফিসার জানিয়েছেন, গত দু’বছরের বেশি সময় ধরে যে চাপ সামলিয়েছে ট্র্যাফিক দফতর, সেতু চালু হলে তার অবসান হবে।
নতুন সেতু খুলে যাওয়ার খবরে স্বস্তিতে স্থানীয় বাসিন্দারাও। তাঁরা জানাচ্ছেন, নিউ আলিপুর বা আলিপুর ঘুরে যাতায়াত করায় শহরের মূল কেন্দ্রে পৌঁছতে এক ঘণ্টা অতিরিক্ত লাগছিল। এ বার সময়ের অপচয় বন্ধ হবে।