ভূগর্ভ থেকে জল তোলার ব্যাপারে রাজ্যে আইন আছে। বাম আমলে তৈরি সে আইন বাম সরকারই মানেনি। বর্তমান তৃণমূল সরকারও মানছে না। অভিযোগ, আইন লঙ্ঘন করে নিউ টাউনে যথেচ্ছ ভাবে গভীর নলকূপ বসাচ্ছে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর। ফলে ভূগর্ভের দূষিত জল ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন নিউ টাউনের মানুষ।
তবে জনস্বাস্থ্য কারিগরি মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “মানুষ জল খাবে। অনুমতি খাবে না। তবে আমরা অনুমতি নিয়ে নেব।” বাম আমলের জনস্বাস্থ্য মন্ত্রী গৌতম দেবের বক্তব্যও ছিল, জল দেওয়ার দায়িত্ব তাঁদের। জল অনুসন্ধান আধিকারিক বিভাগের (স্যুইড) অনুমতির প্রয়োজন নেই। গৌতমবাবুর আমলেই অধিকাংশ নলকূপ বসানো হয়।
কিন্তু কী অনুমতি নেবেন সুব্রতবাবু? নিউ টাউনে মাটির তলায় ১০০ মিটার গভীরে প্রথম জলস্তর সম্পূর্ণ দূষিত। দ্বিতীয়-তৃতীয় স্তরেও দ্রুত দূষণ ছড়াচ্ছে। আশপাশের পুর-এলাকার বর্জ্য এবং আর্সেনিক দুই আক্রমণে এই তিন স্তরের জল ব্যবহার দারুণ বিপজ্জনক। স্যুইড এই রিপোর্ট তৈরি করেছে।
তবুও বাসিন্দাদের জল সরবরাহের জন্য প্রতিদিন ভূগর্ভ থেকে লক্ষ লক্ষ গ্যালন জল তুলছে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের বসানো গভীর নলকূপ। অ্যাকশন এরিয়া ১-এই আছে ২১টি গভীর নলকূপ, অ্যাকশন এরিয়া ২-তে ২০টি ও তিন নম্বর অ্যাকশন এরিয়ায় ১০টি। ৫১টি গভীর নলকূপই হিডকোর নির্দেশে তৈরি। আরও প্রায় ৩০টি গভীর নলকূপ বসানোর তোড়জোড় চলছে। এ ছাড়া, বড় বড় বাণিজ্যিক এবং আবাসিক বাড়ির চত্বরেও আছে গভীর নলকূপ। কিন্তু এতদিন সরকারি বা বেসরকারি কোনও ক্ষেত্রেই নলকূপ বসানোর বৈধ অনুমতি নেওয়া হয়নি। তবে সম্প্রতি কয়েকটি বড় আবাসন এই অনুমতি নিয়েছে।
২০০৫-এ তৈরি হয় ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল গ্রাউন্ডওয়াটার রিসোর্সেস (ম্যানেজমেন্ট, কন্ট্রোল অ্যান্ড রেগুলেশনস) আইন’। আইনানুযায়ী, রাজ্যের কোথাও গভীর নলকূপ বসাতে গেলে সেখানে জলের ভাণ্ডার আছে কি না দেখে চূড়ান্ত ছাড়পত্র দেবে স্যুইড। কিন্তু আগের বাম আমল থেকেই জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর এই অনুমতি নেয় না বলে অভিযোগ।
বাণিজ্যিক ও আবাসিক, দু’ধরনেরই বহুতল তৈরির সময়ে যাতে জলের অভাবে পড়তে না-হয়, তাই নির্মাতা সংস্থাগুলোকে নিজেদের নির্মাণ এলাকার ভিতরে অস্থায়ী গভীর নলকূপ বসানোর অনুমতি দিয়ে আসছে হিডকো। নির্মাণ শেষে নলকূপগুলি বন্ধ করার কথা। একটিও বন্ধ হয়নি। তবে পরিস্থিতি ঘোরালো বুঝে ইতিমধ্যেই বসানো গভীর নলকূপগুলির আইনসম্মত অনুমতি পেতে বড় বড় আবাসনগুলি স্যুইডের কাছে আবেদন জানাচ্ছে।
স্যুইডের হিসেবে সারাদিনে একটি মাঝারি শক্তির বেসরকারি নলকূপ ৪ ঘণ্টা চালিয়ে তোলা হয় ২৬৫ গ্যালন বা ১২০৪ লিটার জল। ৫১টি গভীর নলকূপ রোজ প্রথম চার ঘণ্টায় গড়ে তুলছে ৬১ হাজার ৪০৪ লিটার জল। স্যুইডের হিসেবে, রোজ এক লক্ষ লিটার ভূগর্ভস্থ জল বিনা অনুমতিতে তোলা হচ্ছে নিউ টাউনে।
স্যুইডের মতে, নিউ টাউনে আর্সেনিকের প্রমাণও মিলেছে। আর জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরেরই তৈরি আর্সেনিক টাস্ক ফোর্সের রিপোর্ট বলছে, “উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা দারুণ আর্সেনিক প্রবণ। দুই জেলার লাগোয়া কলকাতা যেমন আর্সেনিকের আওতায়, নিউ টাউনও বাদ যেতে পারে না।”
নিউ টাউন এলাকা “অবশ্যই প্রবল আর্সেনিক-প্রবণ,” জানিয়েছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এনভায়রনমেন্ট স্টাডিজের অধিকর্তা দীপঙ্কর চক্রবর্তী। কলকাতার পাশাপাশি নিউ টাউনেও তিনি এ নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে সমীক্ষা চালিয়েছেন। রাজারহাট ব্লক যেমন আর্সেনিক আক্রান্ত, সংলগ্ন নিউ টাউনে ভূগর্ভের জলেও এই মারণ বিষ প্রবল ভাবে আছে বলে জানান তিনি। রাজারহাট-গোপালপুর, রাজারহাট-বিষ্ণুপুর ১ ও ২, চাঁদপুর, পাথরঘাটা, জ্যাংড়া ও মহিষবাথানে ২৭৭৫টি জলের নমুনা সংগ্রহ করে সমীক্ষা চালান দীপঙ্করবাবুরা। দেখা গিয়েছে, গভীর নলকূপ ছাড়াও নিউ টাউন-সহ রাজারহাট ব্লকে অসংখ্য টিউবওয়েল আছে। প্রতি মাসে নয়া টিউবওয়েল বসানোও হচ্ছে।
নলকূপ বসানো হচ্ছে কারণ, গঙ্গা থেকে পাইপে করে জল এনে শোধন করে নিউ টাউন, রাজারহাট, সল্টলেক, দক্ষিণ দমদম পুর-এলাকায় জল সরবরাহের প্রকল্প এগোচ্ছে খুব ধীরে। সম্প্রতি জনস্বাস্থ্য কারিগরি ও পূর্ত দফতরের জন্য নির্দিষ্ট বিধানসভার স্থায়ী কমিটি পাইপলাইন, সংলগ্ন পথ নির্মাণের কাজ পরিদর্শন করে বিরক্তি প্রকাশ করে। কমিটির প্রধান বিধায়ক সুভাষ নস্কর বলেন, “যা দেখলাম তাতে স্পষ্ট কাজ কিছুই এগোচ্ছে না।”