ভূপতিত: কালবৈশাখীর দাপটে ভেঙে পড়েছে আস্ত গাছ। মঙ্গলবার, খিদিরপুর রোডে। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
এক বিকেলেই শহরের বুকে উপড়ে পড়েছে ৬২টি গাছ। সেগুলির মধ্যে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, শিমুল, কদম, বকুলের সংখ্যা বেশি। ডাল ভেঙেছে ১১০টি গাছের। গত সোমবার বিকেলে মে মাসের প্রথম কালবৈশাখীর দেখা পেয়েছিল কলকাতা। আর তার দাপটেই মাটি থেকে উপড়ে এসে শহরের বিপদ বাড়িয়েছে একের পর এক গাছ। পরিবেশবিদেরা জানাচ্ছেন, কলকাতায় বেশির ভাগ গাছের শিকড় মাটির বেশি গভীরে যেতে না পারার কারণে গোড়া আলগা থাকে। ফলে অল্প ঝড়বৃষ্টিতেই ভেঙে পড়ে তারা। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণেই শহরে গাছের আয়ু কমে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ করছেন তাঁরা। পুরসভার উদ্যান বিভাগ জানাচ্ছে, শহরের ফুটপাত জুড়ে এমন বহু বিপজ্জনক গাছ রয়েছে। কিন্তু তার সংখ্যা কত, সেই সংক্রান্ত কোনও তথ্য পুরসভার কাছে নেই।
পুরসভা সূত্রের খবর, শুধু ঝড়বৃষ্টিই নয়, গত এপ্রিলের শুকনো সময়েও লালবাজারের কাছে একটি বড় গাছ হঠাৎ ভেঙে পড়েছিল। একই ভাবে গত বছরের মে মাসের খটখটে আবহাওয়ায় একটি আস্ত গাছ গাড়ির উপরে ভেঙে পড়ায় গাড়িতে থাকা এক অভিনেত্রী ও তাঁর বাবা আহত হন। পুরসভার উদ্যান বিভাগ সূত্রের খবর, সোমবারের কালবৈশাখীতে শহরের সাত নম্বর বরোয় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গাছ ভেঙেছে। ওই বরোয় ভেঙেছে ২০টি গাছ ও ১৩টি গাছের ডাল। ২ নম্বর বরোয় ভেঙেছে ১০টি গাছ। ১৬ নম্বর বরো ছাড়া বাকি সমস্ত বরোতেই কমবেশি গাছ উপড়ে এসেছে বা ডাল ভেঙে পড়েছে। কেন এমন অবস্থা? পুর উদ্যান বিভাগের এক আধিকারিক জানাচ্ছেন, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়ার মতো গাছের শিকড় মাটির বেশি গভীরে যেতে পারে না। এই গাছগুলি অত্যন্ত নরম প্রকৃতির। তাই ঝড়ের গতিবেগ একটু বেশি হলেই তাদের ভেঙে পড়ার আশঙ্কা থাকে। যে জন্য পুরসভা এই সমস্ত গাছের পরিবর্তে নিম, ছাতিম, দেবদারু, জারুল থেকে শুরু করে নানা রকমের ফলের গাছ লাগানো শুরু করেছে।
পরিবেশকর্মীরা অবশ্য দুষছেন অপরিকল্পিত নগরায়ণকে। তাঁদের অভিযোগ, এর জন্যই শহরের বুকে গাছ বেশিদিন বাঁচছে না। এ ছাড়া গাছের দিকে নজরদারির অভাব রয়েছে বলেও পুরসভার উদ্যান বিভাগকে দায়ী করেছেন তাঁরা। অভিযোগ, গাছ বাঁচানোর ক্ষেত্রে পুরসভার যত্ন ও নজরদারি আদৌ কতটা, তা শহরের পথে নজর রাখলে সহজেই অনুমেয়। আরও অভিযোগ, চারা রোপণের সময়ে তার চার দিকে লোহার খাঁচা দেওয়া হয় ঠিকই, কিন্তু গাছ বড় হয়ে যাওয়ার পরেও সেই খাঁচা খোলা হয় না। এর জন্য গাছের গোড়া ঠিক মতো বাড়তে পারে না। উল্টে গাছ বাঁচানোর সেই খাঁচা এখন আবর্জনা ফেলার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করা হয় অনেক ক্ষেত্রেই। মঙ্গলবার চাঁদনি চক মেট্রো স্টেশন লাগোয়া ওয়াটারলু স্ট্রিটে দেখা গেল, গাছ বড় হয়ে গেলেও খাঁচা খোলা হয়নি। উল্টে গাছের গোড়া খাঁচা ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে এসেছে।
পরিবেশকর্মী বনানী কক্করের অভিযোগ, ‘‘শহরের বুকে গাছ বেশি দিন বেঁচে না থাকার পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে। ফুটপাত পেভার ব্লক দিয়ে ঢেকে দেওয়ার ফলে গাছের শিকড় বেশি দূর যেতে পারে না। গাছের গোড়া থেকে পাঁচ ফুট ছাড় না দিয়েই গোড়াসমেত পেভার ব্লক দিয়ে মুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। আবার পুরসভা গাছ ছাঁটাইয়ের দায়িত্ব দেয় ঠিকাদারদের উপরে। কিন্তু সেই কর্মীরা বৈজ্ঞানিক ভাবে ক্যানোপি আকারে ছাঁটাই করেন না। গাছ ছাঁটাইয়ের সময়ে পুরসভার উদ্যানবিদেরাও তদারকি করেন না। ফলে গাছ বড় হওয়ার আগেই একটু ঝড়বৃষ্টি হলেই ভেঙে পড়ে।’’
হাওড়ার একটি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক আক্রামুল হক বলেন, ‘‘কলকাতায় মাটির নীচে জল ও নিকাশির পাইপ রয়েছে। তাই গাছের শিকড় সহজে মাটির গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। গাছের ক্যানোপি অনুযায়ী শিকড় আড়াআড়িও বাড়তে পারে না, কারণ আশপাশে কংক্রিটের গাঁথনি বা পিচের রাস্তা রয়েছে। ফলে গাছের মূল অতিরিক্ত চাপ, কম্পন ও অক্সিজেনের ঘাটতির মুখে পড়ে। যে কারণে গাছ নিজের ভারী ক্যানোপির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াতে তো পারেই না, উল্টে একটু জোরে হাওয়া দিলেই ভেঙে পড়ে।’’