হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে নাজমা। সোমবার। নিজস্ব চিত্র
নিজেরই বেশির ভাগ দিন দু’বেলা খাওয়া জোটে না। কিন্তু তবু কলকাতার মানসিক হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়া এক নিরাশ্রয় তরুণীকে নিজের ঘরে ঠাঁই দিলেন এক কাগজকুড়ানি ‘মা’।
সোমবার সকালে কলকাতার পাভলভ মানসিক হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে আক্ষরিক অর্থেই যাওয়ার কোনও জায়গা ছিল না নাজমা বিবির। গত আট মাস ওই হাসপাতালই ছিল তাঁর ঘর-বাড়ি। চিকিৎসকেরা সুস্থ বলে জানিয়ে দেওয়ার পরে হাসপাতালের তরফে তাঁর স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বার বিয়ে করে নতুন সংসার পাতা স্বামী স্ত্রীকে ঘরে নিতে চাননি। বরং ওই পক্ষের দুই সন্তানকে ঘরে রাখাও যে তাঁর পক্ষে সমস্যা, সে কথাও সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এই পরিস্থিতিতে বাইরের পৃথিবীতে ফেরাটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল নাজমার কাছে। এমন সময়ে তাঁর সহায় হয়ে উঠলেন এক কাগজকুড়ানি প্রৌঢ়া। সন্তান-সহ নাজমাকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছেন তিনিই। এ দিন হাসপাতাল থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঘুটিয়ারি শরিফে ওই ‘মা’-এর বাড়িতেই ফিরেছেন নাজমা। তাঁর পাঁচ ও আট বছরের দুই সন্তানও সেখানেই থাকবে।
জন্মের পরে বাবা-মায়ের চেহারাই দেখেননি নাজমা ও তাঁর দিদি জসমিন। কলকাতায় এক বেসরকারি সংস্থার হোম-এ বড় হওয়া দুই বোনের বিয়ে হয়েছিল দু’টি পৃথক পরিবারে। তিনটি সন্তানের জন্ম দেন নাজমা। মাস আটেক আগে তাঁর ছ’মাসের ছেলে আচমকাই হারিয়ে যায়। উদভ্রান্তের মতো ছেলেকে সর্বত্র খুঁজে বেরিয়েছেন নাজমা। হদিস মেলেনি। এই সময়েই তাঁর স্বামীর অন্য এক মহিলার সঙ্গে সম্পর্কের কথা জানাজানি হয়। একই সঙ্গে দুই ধাক্কায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি। এক দিন বাড়ি থেকে বেরিয়েও পড়েন। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে পাভলভে ভর্তি করে।
গত আট মাস সেখানেই কেটেছে নাজমার। চিকিৎসকেরা সম্প্রতি তাঁকে সুস্থ বলে ঘোষণা করেন। নাজমার কাছ থেকে তাঁর শ্বশুরবাড়ির হদিস মেলার পরে হাসপাতালের তরফে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধি শুক্লা দাস বড়ুয়া ক্যানিংয়ের কুড়েভাঙা অঞ্চলে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে যান। সেখানে পৌঁছে জানা যায়, স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, দুই সন্তান-সহ নাজমাকে তাঁর বাড়িতে রাখা সম্ভব নয়। খবর যায় নাজমার দিদি জসমিনের কাছেও। নুন আনতে পান্তা ফুরনো সংসারে বোনকে কী ভাবে ঠাঁই দেবেন, সে নিয়ে আতান্তরে পড়েন জসমিন। তাঁর কথায়, “বাড়তি তিন-তিনটে পেটের খাবার জোগানো তো মুখের কথা নয়।”
এই সময়েই খবর পেয়ে এগিয়ে আসেন দিদির শাশুড়ি ৬০ পেরনো মালেকা বেওয়া, রাস্তায় কাগজ কুড়িয়েই যাঁর দিন গুজরান। দু’টি শিশু-সহ নাজমাকে নিজের এক চিলতে ঘরেই ঠাঁই দিয়েছেন তিনি। তার আগে হাসপাতালের তরফে স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যস্থতায় যাবতীয় বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। মালেকার এই সিদ্ধান্তে মুগ্ধ হাসপাতালের চিকিৎসক ও অন্যান্য কর্মীরা। যদিও মালেকা নিজে বিষয়টিকে আলাদা করে কোনও গুরুত্ব দিতে চাননি। তাঁর কথায়, “এ ছাড়া অন্য আর কী করার ছিল? ও আমার মেয়ের মতো। সে ভেসে যেত, সেটা চুপচাপ দেখতাম? আমার যে ক’দিন নুন-ভাত জুটবে, তার ভাগ ওরাও পাবে।”
পাভলভের সুপার গণেশ প্রসাদ বলেন, “মানসিক রোগীদের সমাজে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করাটাই সরকারের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। অনেকেরই যে ঠিকানা হাসপাতালে দেওয়া থাকে, তা ভুল ঠিকানা। ফলে আমরা বাড়ি ফেরাতে পারি না।” একই বক্তব্য মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করা রত্নাবলী রায়েরও। তিনি বলেন, “মানসিক রোগীদের ব্রাত্য করে রাখাটাই যখন সমাজে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছেন, তখন এই ঘটনা একটা অন্য নজির তৈরি করল।”