সদ্যসমাপ্ত বইমেলায় কোন ধরনের বই ঘিরে ভিড় ও আগ্রহ দুই-ই জমেছিল বেশি, তার কি কোনও পরিসংখ্যানগত উত্তর আছে? চোখের দেখায় বলা যায়, কমিকস। এ এমন এক ধারা যা আট থেকে আশিকে বেঁধে রেখেছে আজও। তার উত্তর-আধুনিক ভাই-বেরাদর গ্রাফিক নভেলে মজে নতুন প্রজন্ম থেকে প্রবীণ গবেষক, আর সাদাসাপটা বাংলা কমিকসের জনপ্রিয়তার সিংহাসনটি তো বঙ্গমনে কবে থেকেই পাতা।
ইদানীং কালে কার্টুন নিয়ে যেমন, কমিকস নিয়েও প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা বেড়েছে কলকাতায়। ‘কমিকস কালচার কালেক্টিভ’ নামের একটি গোষ্ঠীর সদস্যেরা— বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায় পিনাকী দে দেবাশিস গুপ্ত ঋতুপর্ণ বসু স্বাগত দত্ত বর্মণ— কাজ করছেন বাংলা কমিক্সের ইতিহাস যাত্রাপথ পরিবর্তন বিবর্তন নিয়ে। সেই ভাবনাই রূপ পেয়েছে কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি (কেসিসি)-র প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। ‘কমিকস ইন বেঙ্গল’ নামে একটি প্রদর্শনী শুরু হচ্ছে আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি কেসিসি-র দোতলায়, চলবে ৯ মার্চ পর্যন্ত। ১৯২০-র দশকে বাংলা কমিকস থেকে সমসময় পর্যন্ত তার পথ হাঁটা ফুটে উঠবে সেখানে। থাকবে বিপুল প্রদর্শ-সম্ভার, যা থেকে বোঝা যাবে কী করে জনসংস্কৃতিতে এত ভালবাসা পেল সে।
বাংলায় কমিকসের শুরুটা চিহ্নিত করা সহজ নয়। অনেক গবেষক বলেন, পটচিত্র ও মন্দিরের গায়ে টেরাকোটা-অলঙ্করণে তার শিকড়। এই প্রদর্শনীটি অবশ্য প্রধানত মুদ্রিত বাংলা কমিকস ঘিরে। সে দিক থেকে দেখলে ১৮৭৪-এর ৩১ জানুয়ারি বসন্তক-এ ছাপা ‘কার্কউড বিলাস, চিটাগং প্ল্যান্টেন’ চিত্র-আখ্যানটিতে কমিকসের অনেক লক্ষণই মজুত। তার পর অনেক পথ পেরিয়েছে সে, সন্দেশ মৌচাক সচিত্র ভারত নবকল্লোল শুকতারা কিশোর ভারতী আনন্দমেলা-সহ বহু সাময়িকপত্র তার সাক্ষী। বিশ শতকের রাজনীতি-আবর্তও বাংলা কমিকসকে দমাতে পারেনি, যুদ্ধ ও যুদ্ধবাজদের সে বিদ্ধ করেছে তীব্র ব্যঙ্গে।
বাংলা কমিকস বলতেই যে অগ্রণীদের নাম মনে পড়ে— নারায়ণ দেবনাথ, কাফি খাঁ (প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ী), ময়ূখ চৌধুরী (শক্তিপ্রসাদ রায়চৌধুরী), শৈল চক্রবর্তী, প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়, সুফি, তুষার চট্টোপাধ্যায়, সুবীর রায় ও আরও অনেকে— এই প্রদর্শনী তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। পত্রপত্রিকায় লিখে-এঁকে এঁরাই জনপ্রিয় করেছেন বাংলা কমিকসকে, তৈরি করেছেন কমিকসপ্রেমী কয়েক প্রজন্ম। চর্চা হবে এঁদের ঘিরেও। পাশাপাশি কমিকস-শিল্পী, গবেষক, সংগ্রাহকদের নিয়ে নানা অনুষ্ঠান: থাকবেন দেবাশীষ দেব অভিজিৎ গুপ্ত সুদেবপ্রতিম বসু প্রমুখ; কর্মশালায় সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায় হর্ষমোহন চট্টরাজ সর্বজিৎ সেন ও শঙ্খ বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবিতে বাঁ দিকে পৌষ ১৩২৮ সংখ্যার সন্দেশ-এ সুখলতা রাওয়ের চিত্র-কাহিনি ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’, তুষার চট্টোপাধ্যায়ের চিত্র-কাহিনি ‘আনন্দমঠ’ (ডানে), মাঝখানে ১৯৭১ সালের সন্দেশ শীত-সংখ্যার প্রচ্ছদ।
জন্মদিনে
“আমি রবীন্দ্রনাথ পড়ে বা শান্তিনিকেতনে ঘুরে সবচেয়ে বড়ো শিক্ষার যে অংশটা দেখতে পাই, তা হলো এই সম্পর্ক তৈরি করবার সৌন্দর্যের— নিজেকে অন্যের কাজে যুক্ত করে দেবার সৌন্দর্যের শিক্ষা। এরচেয়ে বড়ো সৌন্দর্য আর কোথাও নেই।” বলতেন শঙ্খ ঘোষ (ছবি), সঙ্গে এও: রবীন্দ্রনাথের একটা বড় শিক্ষা মনকে মুক্ত, সজাগ, বিচারশীল রাখা, প্রত্যেক মুহূর্তে। কবিতার পাশাপাশি তাঁর গদ্যেও ব্যক্তির স্বতন্ত্র স্বর জেগে থাকে সব অচলায়তন, শাসন-শোষণ, অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে। ৫ ফেব্রুয়ারি, শঙ্খ ঘোষের বিরানব্বই পূর্ণ হওয়ার জন্মদিনটি পালিত হবে পরশু সোমবার সন্ধ্যা ৬টায়, রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবনে। গান গাইবেন বাংলাদেশের দুই শিল্পী, বুলবুল ইসলাম ও শারমিন সাথী ইসলাম (ময়না)। শঙ্খ ঘোষ স্মারক বক্তৃতা দেবেন কবি প্রয়াগ শুক্ল। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধ, রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি, জীবনানন্দ ও শঙ্খ ঘোষের কবিতার অনুবাদক, চিত্রকরদের জীবনীকারও বিশিষ্ট এই মানুষটি।
১২৫ বছরে
১৯২৩, উত্তাল ভারত। তার মধ্যেই কাশী রামকৃষ্ণ মিশনে হাজির এক বঙ্গীয় তরুণ, সঙ্ঘে যোগ দিতে। ব্রিটিশ সরকারের নজর তখন মিশনের উপর, তাই ফিরতে হল, তবে অচিরেই যোগ দিলেন দেওঘর আশ্রমে। স্কটিশ চার্চ কলেজে অর্থনীতির স্নাতক এই তরুণই উত্তরকালে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের একাদশ সঙ্ঘাধ্যক্ষ স্বামী গম্ভীরানন্দ (১৮৯৯-১৯৮৮)। শ্রীরামকৃষ্ণ-পার্ষদ স্বামী শিবানন্দের কাছে মন্ত্রদীক্ষা, ব্রহ্মচর্য ও সন্ন্যাস; কাজ করেছেন দেওঘর থেকে মায়াবতী, ছিলেন প্রবুদ্ধ ভারত পত্রিকার সম্পাদক, বিবেকানন্দের কমপ্লিট ওয়ার্কস-এর অনুপুঙ্খ সম্পাদনা, গীতা উপনিষদ ব্রহ্মসূত্রের ইংরেজি অনুবাদ-সহ বহু গ্রন্থ তাঁর অবদান। জন্মের ১২৫ বছর পূর্তিতে গড়া হয়েছে একটি কমিটি, তারই উদ্যোগে আগামী কাল ৪ ফেব্রুয়ারি দুপুর আড়াইটা থেকে অনুষ্ঠান রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার গোলপার্কে, সন্ন্যাসী ও ভক্ত-অনুরাগীদের উপস্থিতিতে। প্রকাশিত হবে একটি স্মরণগ্রন্থও।
সারস্বত
দুই সারস্বতের বই প্রকাশ পেল জানুয়ারির কলকাতায়। স্বদেশীয় ভারত-বিদ্যা পথিক, বিদেশীয় ভারত-বিদ্যা পথিক, সাংবাদিক-কেশরী হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়-এর মতো গ্রন্থের লেখক, অনুবাদক-সম্পাদক গৌরাঙ্গগোপাল সেনগুপ্তের কলম বহুপ্রজ হলেও তাঁর পূর্ণাঙ্গপ্রতিম প্রবন্ধগ্রন্থের অভাব ছিল। এ বার প্রকাশিত হল তাঁর প্রবন্ধসংগ্রহ (প্রথম খণ্ড), গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বৈদিক ও ধ্রুপদী সাহিত্য এবং সংস্কৃতে সুপণ্ডিত, মহামহোপাধ্যায় অধ্যাপক অমরকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রয়াত গত বছর এপ্রিলে, তাঁরও প্রবন্ধ সংকলন (প্রথম খণ্ড) প্রকাশ পেল। দু’টিরই প্রকাশক সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার। গত ১৪ জানুয়ারি ড. কৃষ্ণা বক্সী মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউট-এর নিজস্ব ভবন পুরীপরাগ-এ এক সারস্বত সভায় বেরোল বইগুলি, সঙ্গে শ্রুতি-কাব্যে রামায়ণ, পুরীপ্রিয়া কুণ্ডুর প্রশ্নোত্তরে ভারতীয় দর্শন-ও।
জীবন-শিল্প
জলের ধারা বাঁধনহারা, তেমনই বাঁধন ভেঙে মিশে গেল নাচ ও গানের নানা প্রবাহ, গত ৭ জানুয়ারি কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি-তে। প্রযোজনাটির নাম ‘অ্যাকোয়া’, নিবেদন করলেন লন্ডন থেকে আসা ফ্লামেনকো নৃত্যশিল্পী মাগডালেনা, কলকাতার কত্থক নৃত্যশিল্পী লোকেশ্বরী ও সঙ্গীতজ্ঞ সুরম্য। এই নাচ ও গানের সূত্রেই এল শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, লোকসঙ্গীত, রক সঙ্গীতও। মাটিকে নৃত্য উৎসর্গ করলেন অতিথি শিল্পী বেদপ্রাণা, বাতাসকে উৎসর্গ ওরিয়েন্টাল নৃত্যশিল্পী অলিভিয়ার, নাচের মধ্যে দিয়ে প্লাস্টিক-বিরোধিতার বার্তা দিলেন আবরার শাকিব, পৃথা চট্টোপাধ্যায় গাইলেন আগুনের সুর! সম্মানিত হলেন বিদুষী সুরঙ্গমা।
শতকণ্ঠে
‘কারার ঐ লোহ-কপাট’-এর ‘নতুন’ সুর নিয়ে জোর বিতর্ক, সেই আবহেই সূচনা হল ছায়ানট কলকাতা-র আয়োজনে কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যগ্রন্থ ভাঙার গান-এর শতবর্ষ উদ্যাপন। ‘কারার ঐ লৌহ-কপাট’ ও ‘দুর্গম গিরি, কান্তার মরু’ গান দু’টি শতকণ্ঠে পরিবেশন করছেন প্রতিষ্ঠানের সদস্যেরা। নতুন বছরে শ্রদ্ধার্ঘ্য রূপে প্রকাশিত ‘শতবর্ষে ভাঙার গান’ শীর্ষক টেবিল ক্যালেন্ডারও: পাতায় পাতায় বিদ্রোহী কবির ছবি, ভাঙার গান নিয়ে মূল্যবান তথ্য। ভাবনা ও তথ্য সংগ্রহ সোমঋতা মল্লিকের, সহযোগিতায় অনুভব পর্ণশ্রী সাংস্কৃতিক ও সমাজ-উন্নয়নমূলক সংস্থা। এ বছর নজরুলের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী, বছরভর শহর জুড়ে তাঁর দেশাত্মবোধক গান গাইবে ছায়ানট কলকাতা, প্রকৃত অর্থে যুক্ত প্রায় আড়াইশো শিল্পী।
প্রথম সব কিছু
১৯৫২-র স্কেচখাতা, চলতে চলতে আঁকা নিসর্গের, মানুষের, জীবনের চিত্র (ছবিতে)। শিল্পপথ-অনুসন্ধানীর জার্নাল যেন। শিল্পী গণেশ হালুইয়ের প্রথম স্কেচ-খাতার ফ্যাক্সিমিলি সংস্করণ প্রকাশ পেল গতকাল, দেবভাষা বই ও শিল্পের আবাসে। সত্তর বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে এসেছেন শিল্পী; খাতার ছবিগুলি যখন জন্ম নিচ্ছে তখন বয়স ষোলো, আজ মধ্য-আশি অতিক্রান্ত। দীর্ঘ শিল্পজীবনে ছবির সঙ্গে একীভূত হয়ে গিয়েছে তাঁর স্বাক্ষর; তাঁর কথায় আজ আর “যা দেখি তা আঁকি না, যা আঁকি তাই দেখি।” প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে ক্যাটালগ প্রকাশই দস্তুর, কিন্তু দেবভাষার তরফে প্রথম স্কেচ-খাতা প্রকাশের উদ্যাপন হচ্ছে শিল্পীর সাম্প্রতিক ৫০টি কাজ নিয়ে প্রদর্শনী ‘টু/ফ্রম’-এর শুভারম্ভে। এই প্রথম এ শহর দেখবে তাঁর ‘স্মল ফরম্যাট’ গুয়াশের কাজ। প্রদর্শনী ২ মার্চ পর্যন্ত, রবিবার বাদে দুপুর ২টো-রাত ৮টা।
শ্রদ্ধাঞ্জলি
নিজে ব্যবহার করতেন, পছন্দ করতেন সুলেখা কালি। ছবির দৃশ্যে যে অনুপুঙ্খ ‘ডিটেলিং’-এর জন্য স্বতন্ত্র তিনি, তার মাঝেও জায়গা করে নিতে দেখা গেছে এই কালির দোয়াতকে। এমনকি লেখাপত্তরেও এসেছে ঘুরেফিরে। সত্যজিৎ রায় যে এই কালির অনুরাগী ছিলেন, বলাই যায় নিশ্চিত করে। ঝর্না কলম আর তার কালি সুলেখা-র হাত ধরে নবজীবন পেয়েছে এই সময়ে, জনপরিসরে সমাজমাধ্যমে কান পাতলেই তার প্রমাণ মেলে। এ বার সত্যজিৎ রায়ের প্রিয় ‘ব্লু-ব্ল্যাক’ শেডের কালিটি নতুন ভাবে তৈরি করে ফিরিয়ে আনল এই বঙ্গীয় প্রতিষ্ঠান; ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’ (ছবি) নামে একটি কালির সিরিজ় তৈরি করেছে তারা, তারই অঙ্গ হিসাবে। গত ১৫ জানুয়ারি তার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হল বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে সন্দীপ রায়ের হাত ধরে, ছিলেন প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার কৌশিক মৈত্র। সদ্যসমাপ্ত বইমেলাতেও সুলেখা-র স্টলে শহরের ঝর্না কলম-প্রেমীদের ভিড় ছিল দেখার মতো।
হিস্পানিক শহর
কলকাতার স্প্যানিশ ভাষা-সাহিত্যপ্রীতি আজকের নয়। সেই ঐতিহ্য-ধারাতেই ইন্দো-হিস্পানিক ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাকাডেমির উদ্যোগে বইমেলার প্রথম সপ্তাহান্তে হয়ে গেল পঞ্চম ‘কলকাতা হিস্পানিক ফেস্টিভাল’, তিন দিন ব্যাপী। শহরে এসেছিলেন ভারতে স্পেনের রাষ্ট্রদূত হোসে মারিয়া রিদাও; স্পেনের জিরোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক এমিলি পুইগ বিলারো বললেন ‘ইমোশনাল ইকোলজি’ নামক নতুন এক সম্ভাবনাময় ধারণা নিয়ে; স্প্যানিশ ভাষা বিশেষজ্ঞ রিনি সিংহ ঘোষ বললেন আর্জেন্টিনার ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে। কোস্টা রিকাকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার ভ্রাম্যমাণ জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা জানালেন পূবালী ও ইন্দ্রনীল, সাইকেলে দক্ষিণ আমেরিকা পর্যটনসূত্রে কোভিডকালে কলম্বিয়ার গ্রামে কৃষক পরিবারে থাকার সত্যি রূপকথা শোনালেন অনির্বাণ আচার্য। অ্যাকাডেমির উদ্যোগে শহরে ফেডারেশন হল-এ তৈরি হতে চলেছে স্প্যানিশ চর্চার নতুন পরিসর, তার আনুষ্ঠানিক সূচনাও হল।