ঐতিহাসিক: সেই সংগ্রহশালা। (ইনসেটে) ম্যালেরিয়া রোধে কুইনাইনের প্রচার। নিজস্ব চিত্র
ম্যালেরিয়া কম্পজ্বর কিম্বা প্লীহাজ্বর প্রতিকারের জন্য কুইনাইন।
একমাত্র অব্যর্থ মহৌষধ ইহাই সেবন কর।
গভর্ণমেন্টের বিশুদ্ধ কুইনাইন এখানে পোষ্ট আফিস এবং রেল ষ্টেসনে পাওয়া যায়।
প্রত্যেক শিশিতে ২০টী বড়ী থাকে।
এনামেলে ছাপানো এমনই বিজ্ঞাপন দেখা যেত ডাকঘরেও। সময়টা উনবিংশ শতকের শেষ ভাগ। ডাক বিভাগ তখন এ দেশের মানুষের বড় ভরসা। তাই ম্যালেরিয়ার সঙ্গে লড়াইয়ে বন্ধু ছিল তারাই। মোবাইল আর আন্তর্জালে কোণঠাসা এই বন্ধুর ইতিহাসটা কিন্তু বেশ আকর্ষণীয়।
কালের গর্ভে চলে যাওয়া ওল্ড ফোর্ট উইলিয়াম টিকে আছে বি বা দী বাগের জেনারেল পোস্ট অফিসের (জিপিও) চত্বরে, তবে ফলক আর পিতলের লাইনে। শোনা যায়, সিরাজউদ্দৌল্লার কলকাতা আক্রমণে ধ্বংস হওয়া ওল্ড ফোর্ট উইলিয়ামের অবশেষ সরাতে প্রায় ছ’বছরে তিন হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। ১৮৬৮ সালে ইউরোপীয় স্থাপত্যের আঙ্গিকে তৈরি হয় জিপিও-র সাদা ভবন। তারই পশ্চিমে ইতালীয় ধাঁচের লাল ইটের তিনতলা বাড়িটি বর্তমানে ডিরেক্টর জেনারেল অব কলকাতা জিপিও। এরই একতলার সংগ্রহশালায় রাখা রয়েছে বিতর্কিত ব্ল্যাক হোলে নিহত সেনাদের প্রতি লর্ড কার্জনের তৈরি কালো মার্বেল স্মারক।
সংগ্রহশালা, যা ‘পোস্টাল মিউজিয়াম’ নামে পরিচিত। ১৯৭৯ সাল থেকে একই জায়গায় রয়েছে সেটি। কয়েক বছর বন্ধ থাকার পরে বছরখানেক আগে নতুন করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। প্রতি কাজের দিন সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত খোলা থাকে সংগ্রহশালা। একবার ঢুকে পড়লেই পরতে পরতে উঠে আসবে অজানা তথ্য।
সদ্য শেষ হয়েছে সিপাহি বিদ্রোহ। শোভাবাজারের বাবু নবকৃষ্ণ দেব ঘটা করে দুর্গাপুজো করবেন মনস্থ করলেন। দুর্গার নতুন সাজ গড়তে রুপোর তবক এল জার্মানি থেকে। এ দেশে তা পৌঁছল ডাকযোগে। নতুন এই সাজ লোকমুখে হয়ে গেল ‘ডাকের সাজ’। সে যুগে পালকি বহন এবং বিশ্রামের জন্য তৈরি ডাকবাংলো নিয়ন্ত্রণ করত ডাক বিভাগ।
তখন সাগরপারের ডাক নিয়ে হুগলির তীরে নোঙর ফেলত জাহাজ। এ শহরে ছড়িয়ে থাকা ভিনদেশি মানুষের কাছে ঘর থেকে বার্তা আসার সে খবর পৌঁছে দিতে নদীর তীরে পতাকা ওড়ানো হত, আর বেজে উঠত বিউগল। পতাকা উত্তোলনের সেই যন্ত্র ও বিউগল, দুই-ই রয়েছে সংগ্রহশালায়। খুঁত-থাকা পয়সা বাতিল করার জন্য ১৯১২ সালে টাঁকশাল থেকে জিপিও-কে কয়েন কাটার যন্ত্র দেওয়া হয়। তা-ও রয়েছে স্মারক হিসাবে। রয়েছে রানারের ব্যবহৃত পোশাক, অস্ত্র, ঘণ্টা আর লন্ঠন। পুরনো মানচিত্র, ডাক পরিষেবার ইতিহাস বহনের সাক্ষী ডাকবাক্স, সিল, স্ট্যাম্পের বিবর্তন সবই রয়েছে নাগালে।
ভারতীয় ডাক বিভাগের কর্মী ছিলেন ‘নীলদর্পণ’ নাটকের রচয়িতা দীনবন্ধু মিত্র। বিজ্ঞানী সিভি রমন ডাক ও তার বিভাগের কলকাতা অফিসে এসে যোগ দেন ১৯১১ সালে। এ সব তথ্যের পাশাপাশি রয়েছে সেই মহামূল্য স্বাক্ষর— ডান দিকে সামান্য হেলিয়ে— শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁরই একটি সেভিংস বই সংরক্ষিত আছে কাচের দেরাজে।
ভারতীয় ডাক ও তার বিভাগের দেড়শো বছর পেরিয়েছে এক যুগেরও বেশি। এ বছর কলকাতা জিপিও-র দেড়শো বছর। সেই উপলক্ষে সংগ্রহশালা নিয়ে নতুন ভাবনার আভাস দিলেন চিফ পোস্টমাস্টার জেনারেল, পশ্চিমবঙ্গ অরুন্ধতী ঘোষ। তাঁর কথায়, “এই উপলক্ষে আরও কিছু সংগ্রহ নিয়ে মিউজিয়ামটি সম্প্রসারণ করা হবে। তবে এ জন্য মিউজিয়াম বন্ধ থাকবে না।’’ মাঝেমধ্যেই স্কুল থেকে পড়ুয়ার দল সংগ্রহশালা দেখতে আসে। তাঁর মতে, “ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি ছোটদের আগ্রহী করতে স্কুল এবং অভিভাবকদের ভূমিকা জরুরি। না হলে অনেক তথ্যের মতো অজানা থেকে যাবে খবরের বোঝা কাঁধে রানারের ছুটে চলার কাহিনিও।’’
সংগ্রহশালার কাচের দরজা ঠেলে বেরোতেই, শেষ কথার রেশ ধরেই দীর্ঘদেহী ধাতব রানারের দিকে টেনে নিয়ে যায় পা জোড়া। এক ধাক্কায় পিছিয়ে যায় সময়। আধুনিক সভ্যতার মালা থেকে খসে পড়া একটি ফুল যেন পুরুলিয়ার সেই প্রত্যন্ত এলাকা, যেখানে আজও পাহাড়-জঙ্গল পেরিয়ে খবরের বোঝা বয়ে হেঁটে যান ওঁরা।
ঢংঢং আওয়াজে সম্বিত ফেরে। ব্যস্ত শহর আর গাড়ির জটলা ঠেলে এগোতে এগোতে ভেসে ওঠে অন্য শহর। সালটা ১৮৯৬। লন্ডনের ‘বিগ বেন’ ঘড়ির নির্মাতা সংস্থার কাছ থেকে সাত হাজার টাকায় কেনা হল গান মেটালে তৈরি চার ডায়ালের ঘড়িটি। জিপিও-র মাথায় ম্যাকিনটশ ও বার্নের তৈরি যে বিশাল গম্বুজ, তারই নীচে স্থান হল ঘড়ির। ১২২ বছরের সাক্ষী সেই ঘড়ি কিন্তু নদীর স্রোতের মতো ক্লান্তিহীন। শুধু শব্দের তীব্রতা কমেছে, তা-ও শহরবাসীর আবেদনে।
তথ্যসূত্র: ডাক ও তার বিভাগ