জনসমাগম: ইদের আগে কেনাকাটার ভিড়। বুধবার, নিউ মার্কেটে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
পাশাপাশি বসে রেশমি বেগম, নেহা খাতুন, অর্পিতা ভৌমিক, সুজাতা হালদার, ইসরাত জাহান, হীরা মাহাতো, মেরি জনসন। সক্কলে মিলে চেনা, অচেনা বন্ধুদের খাবার সাজিয়েছেন। রোজাদার বন্ধুরা খেতে বসা পর্যন্ত অর্পিতা, সুজাতারাও কিছু দাঁতে কাটবেন না। ট্যাংরার বিবিবাজারের ‘সানরাইজ় এস্টেট’-এর কমিউনিটি হলে এ দৃশ্য কিছুটা উলটপুরাণ হয়ে থাকল।
এখনও এ শহরে ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য কয়েকটি পাড়ায় ঘর পেতে সমস্যায় পড়তে হয়। সেখানে সবাই মিলে ইফতারের দৃশ্য খানিক ব্যতিক্রমীই। ট্যাংরার ওই আবাসনে এ বার তপসিয়া, এন্টালি, রাজাবাজার, ট্যাংরার নিম্নবিত্ত পাড়ার কয়েক জন সমাজকর্মী মেয়েকে সামনে রেখে ইফতারের আসর বসেছিল। ওই আবাসনের বাসিন্দারা নিজেরাও বছর বছর ইফতার আসরে বসেন। ঠিক যে ভাবে দুর্গাপুজো বা বড়দিনেও একযোগে শামিল হন।
আবাসনের সম্পাদক সায়করঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায় বা দুর্গাপুজো-কর্তা অসীম সোমেরা বলছিলেন, “পুজোয় মহম্মদ আনোয়ার বা সিটি জোসেফদের বাদ দিয়ে ভাবতেই পারি না। মুসলিম মেয়েরাও সিঁদুরখেলায় আসেন।” এই বার নমাজ ও কোরান পাঠের শেষে প্রার্থনায় অ-মুসলিমরাও যোগ দিয়েছেন। সকলের হাতে খেজুর, মিষ্টি তুলে দিয়েছেন মুসলিম পড়শিরা। ইদ-পরবর্তী কোনও মিলনোৎসবেরও পরিকল্পনা চলছে। লেখক-সমাজকর্মী শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত খুব ছোট থেকেই বাবার সঙ্গে তাঁর পুব বাংলার বন্ধুদের সৌহার্দ্য দেখেছেন। কিন্তু কলকাতার কলেজ বা স্কুলজীবনে মুসলিমদের সান্নিধ্য ততটা পাননি। এখন কাজের সূত্রে মুসলিম বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর নিত্য যোগাযোগ। শর্মিষ্ঠা বলছিলেন, “বন্ধুদের ডাকে ইফতারে যাওয়া এবং তাঁদের বাড়ির অনুষ্ঠানে ডাকা— এটাই স্বাভাবিক। ইফতারে উঁচু-নিচু ভুলে একসঙ্গে বসে খাওয়ার সংস্কৃতিও ভাল মূল্যবোধই শেখায়।”
রাজনীতির বিভাজন-বিষ ছড়ানোর দিনকালে মুসলিম বন্ধুদের ডেকে ইফতার করানোর উদ্যোগও বাড়ছে। শিবপুরের পিএম বস্তিতে এমন উদ্যোগের অন্যতম মুখ নাট্যকর্মী জয়রাজ ভট্টাচার্য। ফুলবাগানে পূর্ব কলকাতা সর্বজনীন পুজোও ছক ভেঙে এ বার ইফতারের আয়োজন করেছিল। মুসলিম সংগঠনের প্রতিনিধিরা ছাড়াও ঘোষণা শুনে সে দিন হাজির পাশেই বিধানচন্দ্র শিশু হাসপাতালে ভর্তি ছোটদের কোনও কোনও অভিভাবক। পুজোকর্তা মানসরঞ্জন দত্তের কথায়, “বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বা সব ভারতীয়কে সমান চোখে দেখার বার্তা দিতেও ইফতারের অনুষ্ঠান প্রতীকী উদ্যোগ।”
সমাজকর্মী দোলন গঙ্গোপাধ্যায়ও এমন অনুষ্ঠানের এক নেপথ্যচারিণী। তাঁরও বক্তব্য, ‘‘সংগঠিত ভাবে ইসলাম বা মুসলিমদের বিষয়ে অপপ্রচারের দিনেও এমন অনুষ্ঠান বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।” ওয়াজিদ আলি শাহের পরিবারের সন্তান শাহেনশাহ মির্জার অভিজ্ঞতা, কলকাতায় প্রতি বছরই রোজায় বাঙালি হিন্দু, মাড়োয়ারি বা শিখ বন্ধুরা কিছু না কিছু খাওয়ানোর বন্দোবস্ত করেন। অ-মুসলিম বন্ধুরা হয়তো মিষ্টি নিয়ে এলেন। আবার ফল পাঠালেন। সৌহার্দ্যের রঙে পড়শির ত্যাগের মাস তখন আরও সুন্দর হয়ে ওঠে।