সম্ভার: এক মাছ বিক্রেতার কাছে ইলিশের পসরা। গড়িয়াহাট বাজারে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
ভাল মানের ইলিশ চাই। সেই আশায় ছুটির সকালে পাঁচ বন্ধু হাওড়া থেকে রওনা দিয়েছিলেন কাকদ্বীপ। সারা দিন গাড়ি নিয়ে চরকিপাক কাটলেও মন্দ কপাল। খালি হাতেই বিরস মুখে বাড়ি ফিরতে হল তাঁদের। ভাল-মন্দ দূর অস্ত্, বাজার থেকে মৎস্য বন্দর ঘুরে মেলেনি একটি ইলিশও!
গত কয়েক দিনে ইলিশ আমদানির এমনই হাল হয়েছে বলে জানাচ্ছেন মৎস্য ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি তাঁরা জানাচ্ছেন, এখন যে ইলিশ বাজারে বিক্রি হচ্ছে তা বাংলার নয়। বরং সেগুলি ভিন্ রাজ্যের কিংবা বরফে থাকা পুরনো মাছ। সেগুলিই চড়া দামে বিকোচ্ছে শহরের বাজারে। গড়িয়াহাটের মাছ বিক্রেতা গণেশ দাস বলেন, ‘‘গুজরাতের ১ কেজি ২০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১২০০-১৩০০ টাকা কেজি দরে। আবার বাংলাদেশের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৫০০ টাকা কেজি দরে। কাকদ্বীপ, দিঘার মাছ কোথায়?’’ মৎস্য ব্যবসায়ী থেকে ট্রলার মালিকদের কথায়, ‘‘সমুদ্রে যেতে না-পারলে মাছ আসবে কোথা থেকে? আবহাওয়া খারাপ থাকায় শেষ ১০ দিন বন্দরেই ট্রলার দাঁড়িয়ে রয়েছে।’’
কাকদ্বীপ, নামখানা, ফ্রেজারগঞ্জের মৎস্য-বন্দর ঘোরার সময়ে সার দিয়ে ট্রলার দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন মাছের খোঁজে যাওয়া যুবকেরাও। চার ভাইয়ের মিলে প্রায় ১৫-১৬টি ট্রলার রয়েছে কাকদ্বীপের রঞ্জিত হালদারদের। তিনি বলেন, ‘‘করোনা, আবহাওয়া সব সামলে যেটুকু সময় সমুদ্রে যাওয়া যাচ্ছে, তখনও খুব বেশি ইলিশ মিলছে না। খুব বেশি হলে একটা ট্রলার ৪০০ কেজি মাছ নিয়ে ফিরছে। আবার কবে ট্রলার রওনা দেবে, ঠিক নেই।’’ লকডাউনের জেরে দূষণের মাত্রা কম হওয়ায় এ বছর ইলিশের জোগান ভাল হওয়ার আশা ছিল। এখন তাতেই ভাটা পড়েছে। কিন্তু কেন? কেন্দ্রীয় মৎস্য শিক্ষা সংস্থানের প্রধান বিজ্ঞানী বিজয়কালী মহাপাত্র বলেন, ‘‘দূষণ কম থাকলেও ইলিশের জন্য যে অনুকূল আবহাওয়া প্রয়োজন, তাতে ঘাটতি রয়েছে। সে কারণেই জোগান কম।’’
বিজয়কালীবাবু জানান, পুবালি বাতাস ও ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে ইলিশের প্রজনন বেশি হয়। সেই সময়েই সমুদ্রের তলদেশ থেকে ইলিশ উপরে উঠে এসে মোহনা দিয়ে মিষ্টি জলের নদীতে প্রবেশ করে। সেখানে ডিম পেড়ে আবার ফিরে যায়। কিন্তু বঙ্গের নদীর নাব্যতা কম থাকাও ইলিশের প্রজনন কম হওয়ার একটি কারণ বলে মত বিজয়কালীবাবুর। কাকদ্বীপ, নামখানা ঘুরে শেষে ডায়মন্ড হারবারের একটি বাজারে ইলিশের খোঁজে হাজির হয়েছিলেন হাওড়ার ওই যুবকেরা। কিন্তু সেখানেও মাছ মেলেনি। আক্ষেপ করে ডায়মন্ড হারবারের আড়তদার বিজয় সিংহ বলেন, ‘‘ভাল মাছ কোথায়? কয়েক দিন আগে কিছু আমদানি হয়েছিল। এখন সেটাও নেই। আবহাওয়া ভাল হলে আবার ট্রলার গেলে তবে বোঝা যাবে।’’
বিজয় জানান, মূলত ডায়মন্ড হারবার ও দিঘা থেকে বিভিন্ন পাইকারি মাছের বাজারে ইলিশ সরবরাহ করা হয়। সেখান থেকে সেগুলি আসে কলকাতার বাজারে। কিন্তু এখন শহরে বিক্রি হওয়া ইলিশ আসলে গুজরাতের। নর্মদা নদীর ওই মাছ রফতানি হয় এই রাজ্যে। কিন্তু বঙ্গের ইলিশের স্বাদের সঙ্গে তার তুলনা হয় না বলেই দাবি তাঁর। তিনি বলেন, ‘‘নর্মদা নদীর জল নোনতা। তাই মাছের স্বাদ তত ভাল নয়। কিন্তু ক্রেতারা তো আর সেটা বোঝেন না!’’ আরও অভিযোগ, জোগান কমের সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির বিক্রেতা ভিন্ রাজ্যের ইলিশই ইচ্ছে মতো দামে বিক্রি করছেন।
তবে ভিন্ রাজ্যের ইলিশের ভাপা বা সর্ষে দিয়ে রাঁধা পদ খেতে নারাজ অনেকেই। তাঁদের উদ্দেশ্যে বিজয়কালীবাবু ও অন্য মৎস্য বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘‘নিরাশ হবেন না। বঙ্গের ইলিশের আশা এখনও রয়েছে।’’