প্রবাদে রয়েছে ছেঁড়া শিকড় মাটি পায় না। বন দফতরের সহায়তায় এ বার সেই প্রবাদকে খণ্ডন করলেন পূর্ত দফতরের কর্মীরা। সৌজন্যে একটি পাকুড় গাছ।
দুই দফতর সূত্রে খবর, কলকাতা হাইকোর্টে ‘ট্র্যাভেলেটর’ (চলমান হাঁটা পথ) প্রকল্পের কাজ শুরুর সময়ে পূর্ণ বয়স্ক বকুল, আম, ডুমুর, বট এবং একটি পাকুড়-সহ পাঁচটি গাছ কাটার প্রয়োজন হয়েছিল। চারটি গাছ কাটা পড়লেও বেঁচে গিয়েছে পাকুড় গাছটি। এখন সেই গাছটি ইডেন গার্ডেনে দিব্যি রয়েছে।
বন দফতরের এক আধিকারিক জানান, পাকুড় গাছটি ছিল হাইকোর্টের ‘বি’ গেটের সামনে। অন্য চারটি গাছের মতো পাকুড় গাছটিরও ডালপালা কাটা শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গাছটির উপরে নজর পড়ে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুরের। তাঁর ইচ্ছাতেই হাইকোর্ট ও পূর্ত দফতরের প্রশাসনিক কর্তারা যোগাযোগ করেন বন দফতরের সঙ্গে।
এর পরেই বন দফতরের তরফে পাকুড় গাছটিকে হাইকোর্টের ‘বি’ গেটের সামনে থেকে সরানোর অনুমতি দেওয়া হয়। ইডেন গার্ডেনের কোনখানে বসানো হবে তাও ঠিক করে দেওয়া হয়। পূর্ত দফতরের সিটি ডিভিশনের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার (ওয়েস্ট) অয়ন মিত্র বলেন, ‘‘বন দফতর সেই সময়ে আমাদের গাছটি সরানোর অনুমতি এবং জমি ঠিক করে দেওয়ায় আমরা গাছটিকে বাঁচাতে পারি।’’
বন দফতরের বিশেষজ্ঞরা জানান, পাকুড় গাছটির আনুমানিক বয়স ৫০ বছর। গাছটির ব্যসার্দ্ধ ৩৮০ সেন্টিমিটার। উচ্চতা ছয় মিটার।
৫০ বছর বয়সী একটি পাকুড় গাছকে তুলে নিয়ে অন্য জায়গায় প্রতিস্থাপন করা এবং তাঁকে বাঁচানো অত্যন্ত কষ্টের কাজ বলে জানান উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের বক্তব্য, এই সব ক্ষেত্রে গাছটির মরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে ৯০ শতাংশ এবং বাঁচার সম্ভাবনা থাকে মাত্র দশ শতাংশ।
উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকুড় হচ্ছে ডুমুর গোত্রীয় গাছ। গাছটি বট, অশ্বত্থ, ডুমুর, জগডুমুরের সম গোত্রীয়। অশ্বত্থের সঙ্গে পাকুড়ের বাহ্যিক চেহারার এত মিল যে অনেকেই এখনও পাকুড়কে অশ্বত্থ বলে ভুল করেন। পাকুড়ও অশ্বত্থের মতো দীর্ঘাকৃতির হলেও এর পাতায় অশ্বত্থের মতো লেজ থাকে না। পাকুড় ঝুড়ি বহুল হয়। অশ্বত্থের ফল পাকলে ঘন বেগুনি রঙের হয়। পাকুড়ের ফল পাকলে কমলা রঙের হয়। পাকুড়ের পাতা এবং ডাল ভাঙলে এক ধরনের সাদা আঠা বের হয় বলে গ্রাম বাংলায় গাছটি ‘ক্ষীরি’ নামেও পরিচিত। গাছটির বিজ্ঞান সম্মত নাম হচ্ছে ‘ফাইকাস ইনফেকটোরিয়া’। এ নামেই গাছটি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পরিচিত।
রাজ্য বন দফতরের অবসরপ্রাপ্ত উদ্ভিদ ও উদ্যান বিশেষজ্ঞ অরবিন্দ ঘোষ বলেন, ‘‘ফাইকাস গোত্রের বাইরে যেমন আম, জাম, লিচু, তেঁতুল জাতীয় গাছকে কোথাও তুলে নিয়ে গিয়ে বসাতে হলে গাছের বয়স হতে হবে আট থেকে দশ বছরের মধ্যে। আর ফাইকাস গোত্র ভুক্ত হলে যেমন বট, অশ্বত্থ, ডুমুর, জগডুমুরের ক্ষেত্রে হলে এই সুযোগটা ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত মেলে। তাও সরানোর কাজটা গরমের শুরু থেকে বর্ষার মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে সেরে ফেলতে হবে। কিন্তু একটি ৫০ বছরের পাকুড় গাছকে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় তুলে এনে বসানো এবং তাকে বাঁচানো অসাধ্য সাধন করার সমান।’’
রাজ্য জীববৈচিত্র পর্ষদের সদস্য এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক নন্দদুলাল পাড়িয়ার মতেও একটি পঞ্চাশ বছরের পাকুড় গাছের শিকড় বাঁচিয়ে তাকে স্থানান্তর করার কাজ সহজ নয়। তিনি বলেন, ‘‘এই স্থানান্তরের জন্য যে জায়গায় নতুন গাছটি পোঁতা হবে তার মাটি পরীক্ষা করা দরকার। শিকড় যাতে মাটির গভীরে যায় তার জন্য গভীর করে গর্ত খোঁড়ার প্রয়োজন। শিকড়ের কোনও অংশ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তার জন্য নজর রাখতে হবে। এই সবের পরেও গাছটি আগে যেই জায়গায় ছিল সেই জায়গার সঙ্গে নতুন জায়গার আবহাওয়া-সহ অন্যান্য পারিপার্শ্বিক শর্ত মিলে গিয়েছে বলেই গাছটি বেঁচে গিয়েছে।’’
বন দফতরের কর্তারা জানান, কাজটি করেছে পূর্ত দফতর। তাঁরা তাদের পরামর্শ দিয়েছিলাম। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘পাকুড় গাছটির বয়স পঞ্চাশ বছর হওয়ায় শুরু থেকেই কাজটিতে ঝুঁকি ছিল। কারণ অনেক সময়ে এই ধরনের কাজে সংক্রমণ হয়েও গাছটির মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে। তাই এই ধরনের কাজে যারা বিশেষজ্ঞ রয়েছেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলে পূর্ত দফতরকে পরামর্শ দেওয়া হয়।’’
দুই দফতর সূত্রে খবর, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে হাইকোর্ট চত্বর থেকে পাকুড় গাছটি সরানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এর পরে গাছটির ডালপালা অত্যন্ত সাবধানে ছাঁটা হয়। ক্রেন দিয়ে গাছটিকে তুলে আনা হয় ইডেন গার্ডেনে। গাছটির বিভিন্ন অংশে সংক্রমণ আটকাতে ওষুধ দেওয়া হয়। পোঁতার পরে গাছের চার দিকে বাঁশ দিয়ে ঠেকনা এবং গাছের উপরে ছাওনি দেওয়া হয়। কোনও রকম সংক্রমণ যাতে না ঘটে তার জন্য গাছটির উপরে নিয়মিত নজরদারি চালানো হয়। মাস পাঁচেক পরে গাছটির উপরের ছাওনি এবং বাঁশের ঠেকনাগুলি সরিয়ে দেওয়া হয়।
সব শুনে বন মন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মণ বলেন, ‘‘এই ঘটনা আরও এক বার প্রমাণ করল বন দফতরে এখনও কিছু কর্মী রয়েছেন যাঁরা দক্ষতার সঙ্গে কাজটি করেন।’’