প্রতীকী ছবি।
রাজ্যের সরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজগুলিতে রোগীদের শরীরে যে ‘সিঙ্গল চেম্বার পেসমেকার’ বসানো হচ্ছে, তার মান নিয়ে স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে সরকারি হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একাংশের।
ওই পেসমেকারের মান ‘অত্যন্ত খারাপ’ এবং যে কোনও মুহূর্তে সেটির যন্ত্রাংশ বিকল হয়ে রোগীর প্রাণসংশয় হতে পারে বলে জানিয়ে সম্প্রতি স্বাস্থ্য দফতরে আলাদা আলাদা ভাবে চিঠি দিয়েছেন এসএসকেএম এবং আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হৃদ্রোগ চিকিৎসকেরা। কিন্তু তার পরেও এ নিয়ে স্বাস্থ্য দফতর উদাসীন বলে অভিযোগ।
গত এপ্রিলে দরপত্র ডেকে ‘সিঙ্গল চেম্বার পেসমেকার’ তৈরি করা একাধিক সংস্থার মধ্যে থেকে একটি সংস্থাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। চলতি বছরের মে মাসে সেই সংস্থার তৈরি সিঙ্গল চেম্বার পেসমেকার লাগানোর পরেই এসএসকেএমের এক রোগী ভেন্টিলেশনে চলে যান এবং তার পরে তাঁর মৃত্যু হয় বলে গুরুতর অভিযোগ ওঠে। সেই সময়ে টেকনিক্যাল কমিটি ও তদন্ত কমিটির একাধিক বৈঠক হয়। সেই ঘটনার জেরে জুন ও জুলাইয়ে ওই পেসমেকারের ব্যবহার সাময়িক বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু তার পরে ফের তার ব্যবহার শুরু করার অনুমতিদেয় স্বাস্থ্য দফতর! এতেই বহু চিকিৎসক ক্ষুব্ধ।
স্বাস্থ্য দফতরের হিসাব অনুযায়ী, ইতিমধ্যেই রাজ্যে ৫০০ জনের শরীরে ওই বিতর্কিত সিঙ্গল চেম্বার পেসমেকার বসানো হয়েছে। চিকিৎসকদের বক্তব্য, ‘‘জেনেশুনে এত জন রোগীর শরীরে এমন পেসমেকার বসানো হয়েছে, যার মানের কোনও বালাই নেই। এ তো রোগীদের চরম বিপদে ঠেলে দেওয়ার শামিল। বিষয়টা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।’’
এসএসকেএমের এক প্রবীণ ও বিশিষ্ট হৃদ্রোগ চিকিৎসকের কথায়, ‘‘ওই পেসমেকারের কখনও লিড ফেল করছে, কখনও সার্কিট কাজ করছে না। আবার কখনও ইন্টারমিডিয়েন্ট বিকল হচ্ছে। আমাদের হাসপাতালেই এক জন এই ভাবে মারা গেলেন। তার পরেও একাধিক ক্ষেত্রে ওটিতে রোগীর দেহে যখন ওই পেসমেকার বসাতে বাধ্য হচ্ছি, দেখছি, তা কাজ করছে না। সঙ্গে সঙ্গে বদলে অন্য একটা বসাতে হচ্ছে। এ ভাবে রোগীর কিছু একটা হয়ে গেলে তখন দায়ী করা হবে আমাদের। অবিলম্বে এই পেসমেকার বাতিলের জন্য আমরা স্বাস্থ্য দফতরে চিঠি দিয়েছি।’’
উল্লেখ্য, ওই সংস্থার পেসমেকারের খারাপ মানের কারণে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি অসম সরকারের শিক্ষা-স্বাস্থ্য অধিকর্তা নির্দেশিকা জারি করে এর ব্যবহার বন্ধের ঘোষণা করেছেন। চিকিৎসকদের কথায়, ‘‘পশ্চিমবঙ্গেও শুধু সরকারি ক্ষেত্র ছাড়া বেসরকারি হাসপাতালে এই পেসমেকারের ব্যবহার কার্যত শূন্য।’’
কিন্তু যেখানে মানুষের জীবনের ঝুঁকির কথা বলছেন চিকিৎসকেরা, সেখানেকেন স্বাস্থ্য দফতর কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না?
রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর্সের ডেপুটি ডিরেক্টর প্রশান্ত বিশ্বাস বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করব না।’’ ড্রাগ অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট বিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারি চয়ন সাহার মন্তব্য, ‘‘স্পেশ্যাল সেক্রেটারি চৈতালি চক্রবর্তীকে জিজ্ঞাসা করুন।’’ আর চৈতালি বলছেন, ‘‘যা বলার স্বাস্থ্যসচিব বলবেন।’’ স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগম বিষয়টি জানার পরে প্রথমে মতামত জানাবেন বলে মেসেজ করলেও পরে তাঁকে ফোন বা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ করা হলেও জবাব মেলেনি।
ড্রাগ অ্যান্ড ইকুইপমেন্টের অন্য এক কর্তা বলেন, ‘‘বেজায় ফ্যাসাদে পড়েছেন কর্তারা। সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা পুরোপুরি নিখরচায় দিতে গিয়ে ভাঁড়ারে মারাত্মক টান। তাই সংশ্লিষ্ট পেসমেকার সংস্থা সিঙ্গল চেম্বার পেসমেকারেরদাম সব চেয়ে কম হাঁকায় (এদের দু’ধরনের সিঙ্গল চেম্বার পেসমেকারের একটির দাম ৪৩ হাজার, অন্যটির৪৯ হাজার) দরপত্রে তাদেরই বাছাই করা হয়। এখন তা বাতিল করতে হলে দ্বিগুণ দাম দিয়ে অন্য পেসমেকার কিনতে হবে।’’ সূত্রের খবর, বছরে এই সিঙ্গল চেম্বার পেসমেকার লাগে প্রায় ছয়-সাত হাজার। তাই ওই সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের এত গড়িমসি। আবার এর পিছনে দফতরের আধিকারিকদের একাংশের কমিশনের স্বার্থ জড়িত থাকার অভিযোগও উঠছে।
তবে পেসমেকার সরবরাহকারী সংশ্লিষ্ট সংস্থার তরফে সুশান্ত লাহিড়ী বলছেন, ‘‘সরকারি ডাক্তারদের অনেকে স্বাস্থ্য ভবনে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাচ্ছেন। বলছেন, পেসমেকারের মান ভাল নয়। কেন বলছেন, বুঝতে পারছি না। কারণ, আমাদের যন্ত্রে ত্রুটি কেউ প্রমাণ করতে পারেননি। স্বাস্থ্যকর্তাদের সঙ্গেও কথাহয়েছে। এসএসকেএমে যে রোগীর মৃত্যুর কথা বলা হচ্ছে সেখানেও পেসমেকারের কোনও ত্রুটি প্রমাণিত হয়নি। তার পরেও আমাদের পেসমেকারের সরবরাহ দেড় মাসের জন্য বন্ধ করা হয়েছিল।’’