রোজা ভাঙার সময়টা রোজ কখন আসবে, তার জন্য মুখিয়ে থাকেন হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে। ভোজ-বিলাসে এখনও অত ভেদাভেদ করে না কলকাতা। ধর্ম নিয়ে হুলস্থুলের এ অস্থির সময়ে এ কথা রূপকথার মতো ঠেকলেও, একেবারেই সত্যি!
এ শহরে যেন রোজই নতুন করে আপন হয়ে ওঠে অন্য কোনও এক প্রদেশের খাদ্য। এখনও। ইদানীং তেমনই এক খাবারের দৌলতে শহর কলকাতার খাদ্য রসিকদের কাছে আরও একটু গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে রমজান মাসটা। উপলক্ষ হালিম।
হরেক রকমের ডাল, ডালিয়া, গোটা মশলা, মাংস— সবে মিলে জিভের ডগায় স্বর্গলাভ! রোজা ভাঙার পরে ইফতারের ভোজের অঙ্গ অন্যতম উপাদেয় এই রান্না। শহরে ছোট-বড় বহু রেস্তরাঁ কিংবা রাস্তার ধারের ছোট্ট খাবারের ঠেক— হালিমময় এই সময়ে ভিড় সর্বত্র। শুধু এই হালিমের অপেক্ষায় গোটা রমজান মাস এখন বড় বড় মোগলাই খানার দোকানে দুপুর থেকে বিকেলটা রীতিমতো চলে ঠেলাঠেলি-ধাক্কাধাক্কি। সূর্য ডুবতে না ডুবতেই খালি হয়ে যায় হাঁড়ি। পার্ক স্ট্রিটের
এক নামজাদা মোগলাই খানার দোকানের ম্যানেজার ইশতিয়াক আহমেদ যেমন বলছিলেন, দুপুর দু’টো থেকে লাইন পড়ে তাঁদের দোকানে। সন্ধ্যা ছ’টা না বাজতেই হাঁড়ি শেষ। শুরু হয়ে যায় পরের দিনের হালিম রান্নার প্রস্তুতি।
ইফতারির খাবার হিসেবে শুধু এই সময়টুকুই সর্বত্র পাওয়া যায় হালিম। বাকি বছরভর মাঝেমধ্যে রাস্তার ধারের দু’-একটা রাস্তার ধারের খাবারের দোকান কিংবা ছেলা করে বিক্রি হয় হালিম। তবে মূলত রোজা ভাঙার পরে ইফতারের খাবার হিসেবে এই হালিম পরিচিত হলেও, রোজা রাখেন না এমন বহু মানুষও হালিমে মজে থাকেন এই সময়টা। পার্ক সার্কাস, জাকারিয়া স্ট্রিট, ধর্মতলা চত্বরের ছোট্ট গলি— রোজ বিকেলের ভিড়ই সে কথা বলে দেবে।
অথচ এই হালিম একেবারেই বাঙালির আপন কোনও খাবার নয়। সাবেক বাঙালি মুসলমান সমাজে হালিম দিয়ে রোজা ভাঙার চল কোনও দিনই ছিল না বলে জানাচ্ছেন সমাজকর্মী সাবির আহমেদ। কলকাতার বিভিন্ন মুসলমান পাড়ার খাওয়াদাওয়া নিয়ে গবেষণার কারণে হালিম-চর্চাও যথেষ্ট করেছেন তিনি। সাবির বলছিলেন, ‘‘রমজান মাসে ঘরে ঘরে হালিম তৈরির চল মোটেও নেই বাঙালি মুসলমান সমাজে। কলকাতায় থেকে যাওয়া উত্তর ভারতীয়দের কেন্দ্র করেই হালিম খাওয়ার চল বেড়েছে এ শহরে।’’
যাদবপুর বিশ্বদ্যালয়ের গবেষক নাসির হোসেন জানান, ইফতারের পাতে হালিম খাওয়া তিনি শুধু কলকাতাতেই দেখেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বর্ধমানে মামার বাড়িতে গেলে কখনও হালিম পেতাম না। বাড়িতে তো আসতই না, এমনকি, বাইরে গিয়ে কিনেও খাওয়া যায় না সে অঞ্চলে।’’ কলকাতার সামান্য বাইরে কোনও গ্রাম কিংবা মফস্সলে এখনও রোজা ভেঙে একটু শরবত, খেজুরের পরে মূলত মাছ-ভাতেরই চল বলে জানাচ্ছেন নাসির।
তাই বলে এ শহরে হালিম নতুন নয়। নাসির জানান, পার্ক সার্কাস চত্বরে বেড়ে ওঠার কারণে ছোটবেলা থেকে ইফতারে হালিম খাওয়ার প্রথা দেখেছেন তিনি। একটু বড় হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ধর্মতলা চত্বরেও আসতেন হালিম অভিযানে।
তবে নাসিরের বাড়িতে কখনও হালিম রান্না হয়নি। ইশতিয়াকের বক্তব্য, তাঁরাও বাড়িতে রোজা ভাঙার সময়ে নিয়মিত হালিম খান না। সাবির জানান, ইফতারে হালিম খাওয়ার চল মূলত লখনউ, ইলাহাবাদ অঞ্চলের। বাঙালিরা হালেই মজেছেন এই ভোজ-বিলাসে।
বাঙালি বাড়িতে বড় দাওয়াত দিলে আজকাল আসে হালিম। তবে দোকান থেকে কিনে। ইশতিয়াক বলেন, ‘‘আমাদের দোকানে হালিম বিক্রি হয় বছর কুড়ি ধরে। তবে আগে এত মানুষ কিনতেন না। গত পাঁচ-সাত বছরে হালিমের চাহিদা প্রচণ্ড বেড়েছে।’’ ইফতারের দাওয়াত থেকে বা শখের সান্ধ্য ভোজ, সবের জন্যই বড় বড় কৌটো-ভর্তি চিকেন হালিম, মটন হালিম যায় তাঁদের পার্ক স্ট্রিটের দোকান থেকে। হালিম-প্রেম হঠাৎ বাড়ায় এখন ঘরেও বানানোর ইচ্ছে হচ্ছে অনেকের। তাই ‘হালিম মিক্স’-ও বিকোচ্ছে দোকানে দোকানে।
অন্যান্য মোগলাই খানা যেমন ভাবে একে একে আপন হয়েছে এ শহরের, গত এক দশকে ধীরে ধীরে সে ভাবেই জায়গা করেছে হালিম। বলতে ক্ষতি নেই, উন্মাদনার নিরিখে হালিমই যেন এ শহরের নতুন বিরিয়ানি!