মৃত্যু মায়ের, ভয়ের বৃদ্ধাবাসেই ঠাঁই নির্যাতিতার

মৃতার মেয়ে, নির্যাতিতার দিদি জানান, এ দিন রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ তাঁকে ফোন করেন বৃদ্ধাবাসের মালিক হরেকিশোর। এক আত্মীয়কে নিয়ে এর পরে তিনি ওই বৃদ্ধাবাসে যান।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৯ ০১:৩২
Share:

প্রতীকী ছবি।

বৃদ্ধাবাসের চৌকিতে শুয়ে বৃদ্ধার প্রশ্ন ছিল, ‘‘মেয়েটা কোথায় বেরিয়ে গিয়েছিল শুনেছিলাম। ভাল আছে তো?’’ গণধর্ষণের অভিযোগ করা মেয়ে ভাল আছে জানানো হলেও তাঁর সঙ্গে আর দেখা হল না মায়ের। বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর শারীরিক অবস্থার প্রবল অবনতি হয়। সাড়ে ১০টা নাগাদ রক্তবমি করেন। এর পরেই তাঁর শ্বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায় বলে জানান তিনি যে বৃদ্ধাবাসে ছিলেন, সেটির মালিক হরেকিশোর মণ্ডল। বাড়ি যেতে না পেরে নির্যাতনের যন্ত্রণা নিয়ে মেয়েকে যে বৃদ্ধাবাসেই থাকতে হচ্ছে, তা-ও জেনে গেলেন না ওই বৃদ্ধা।

Advertisement

মৃতার মেয়ে, নির্যাতিতার দিদি জানান, এ দিন রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ তাঁকে ফোন করেন বৃদ্ধাবাসের মালিক হরেকিশোর। এক আত্মীয়কে নিয়ে এর পরে তিনি ওই বৃদ্ধাবাসে যান। রাত পর্যন্ত খবর, চিকিৎসকেরা দেখে মৃত ঘোষণার পরে মৃত্যুর বিষয়টি পঞ্চসায়র থানায় জানানো হয়।

এর মধ্যে নির্যাতিতাকেও নিয়ে আসা হয় মায়ের দেহের কাছে। তিনি থাকছিলেন হরেকিশোরেরই অন্য ১১টি বৃদ্ধাবাসের একটিতে। কারণ, গণধর্ষণের পরেও পরিবার তাঁকে বাড়ি ফিরিয়ে নেয়নি। অন্য কোনও হোমও জায়গা দেয়নি। সরকারি হোমে গেলে সঙ্গে সঙ্গে জায়গা না-ও মিলতে পারে বলে জানিয়েছিল পুলিশ।

Advertisement

এর আগে ‘সেবা ওল্ড এজ হোম’-এর বিরুদ্ধে কোনও রকম নিরাপত্তা না থাকার অভিযোগ উঠেছিল। এত কিছুর পরে নতুন বৃদ্ধাবাসে, যেখানে নির্যাতিতাকে রাখা হয়েছে, সেখানে শুধু তাঁর জন্যই নিয়োগ করা হয়েছে সর্বক্ষণের এক জন নিরাপত্তাকর্মী। বৃহস্পতিবার সেখানে গেলে দেখা গিয়েছিল, ভিতরের দিকের একটি ঘর বরাদ্দ হয়েছে ওই মহিলার জন্য। ঘরের মেঝেতে তেল চিটচিটে চৌকি পাতা। মাথার পাশে ঝুল ধরা টেবিল পাখা। চৌকিতে তোশকের বালাই নেই। তাতে কোনও মতে পেতে দেওয়া হয়েছে চাদর। ন্যূনতম যেটুকু পরিচ্ছন্নতা থাকা দরকার, তার বালাই নেই। ঘরে অন্যমনস্ক ভাবে জানলার দিকে তাকিয়ে মহিলা। নাম ধরে ডাকলেও উত্তর দিচ্ছিলেন না এক বারে। চোখে-মুখে এখনও কালশিটের দাগ স্পষ্ট। কথা বলতে বলতে মাঝেমধ্যেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলেন। সম্বিৎ ফেরানোর চেষ্টা করলে বিরক্ত হয়ে বলছিলেন, ‘‘আমি ওদের দেখেছি। পুলিশ সামনে আনলেই চিনিয়ে দেব।’’

আরও পডু়ন: সরকারি কর্মীদের কাজে মন নেই, ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী

ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পরেও অবশ্য পঞ্চসায়রের গণধর্ষণ-কাণ্ডে কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। মহিলা যে বৃদ্ধাবাসে রয়েছেন, সেখানকার কর্মীরা জানান, তিনি কিছুই খেতে চাইছেন না। রাতেও ঘুমোচ্ছেন না। পুলিশের গাড়ি প্রতিদিন তাঁকে লালবাজার নিয়ে যাচ্ছে।

তবে তাঁর মতো বছর ঊনচল্লিশের এক জন মহিলা কেন বৃদ্ধাবাসে থাকবেন, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মহলে বিতর্ক শুরু হয়েছে। তার পরেও মহিলাকে সরকারি হোমে কেন পাঠানো হয়নি? নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতরের মন্ত্রী শশী পাঁজা বলেন, ‘‘বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। পুলিশ ব্যাপারটা বলতে পারবে।’’ পঞ্চসায়রের ওই এলাকা কলকাতা পুলিশের পূর্ব ডিভিশনের অন্তর্গত। সেখানকার ডিসি রূপেশ কুমার এ দিন বলেন, ‘‘ওই মহিলার বাড়ির লোক যা চেয়েছেন, সেই মতোই করা হয়েছে।’’

আরও পডু়ন: দীর্ঘ ন’বছর পরে প্রেসিডেন্সি ফের এসএফআইয়ের

মহিলার দিদির অবশ্য দাবি, তিনি কাজ সামলে ছোট ছেলেকে দেখাশোনা করারও সময় পান না। তাই অসুস্থ বোনকে মা যেখানে ছিলেন, সেই বৃদ্ধাবাসেই রেখে এসেছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘বৃদ্ধাবাসের মালিক হরেকিশোর বোনকে রাখতে চাননি। আমরা পুলিশকে বলেছিলাম, বোনকে সরকারি হোমে পাঠানোর জন্য। কিন্তু পুলিশ বলে, তাদের হোমে থাকার জায়গা এখনই না-ও মিলতে পারে। সে ক্ষেত্রে লিলুয়ার হোমে রাখতে হবে বোনকে। তবে তদন্তের জন্য সেখান থেকে বারবার বোনকে কলকাতায় নিয়ে আসা শক্ত। তাই বাধ্য হয়েই..!’’

মায়ের মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙে পড়া মহিলা অবশ্য এর পরে বলেন, ‘‘ফোন করলেই বোন বাড়ি যেতে চায়। মাকে তো আর ফেরাতে পারলাম না। বোনটাকে নিয়ে যেতে চাই। কিন্তু আমার হাত-পা বাঁধা।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement