স্টিফেন কোর্টের ঘটনায় মৃতদের স্মরণ। সোমবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
রাতের অন্ধকারে আচমকা ঘুম ভেঙে যায়। আধো-চেতনে ভেসে ওঠে সৌরভের মুখ। আর বালিশে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে ওঠেন শৈলেন।
এক অবর্ণনীয় আক্রোশ এসে মাথার ভিতরে দাপাদাপি শুরু করে। তরতাজা ২১ বছরের ছেলে, একমাত্র সন্তান সৌরভের মৃত্যুর পাঁচ বছর পরেও এতটুকু কমেনি সেই আক্রোশ। উল্টে উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। যে স্টিফেন কোর্টের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড কেড়ে নিয়েছিল শৈলেন বারিকের ছেলের প্রাণ, আজ সেই বাড়িটার নতুন পলেস্তরা দেখে ছটফট করে ওঠেন। মনে হয়, আগুনে পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া বাড়িটাই তো ঠিক ছিল। সেই ছবিটার মধ্যে কোথাও যেন সৌরভের অস্তিত্বটুকু রাখা ছিল। এখন যেন সব কিছু মুছে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে।
২৩ মার্চ, ২০১০। তার পাঁচ বছর কেটে যাওয়ার দিনে, সোমবার স্টিফেন কোর্টের এক দিকের গেটের থামে হেলান দিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাধনা। মাথাটা পিছনের দিকে ঝোঁকানো। রোদ পড়ে চিকচিক করছে চোখের কোনা। সামনে কয়েকটা ছবি, ইতস্তত ফুলের মালা, ধূপ, মোমবাতি। বাপ-মরা ছেলেটার আজ ক্লাস ইলেভেনের কেমিস্ট্রি পরীক্ষা ছিল। তাকে পরীক্ষার হলে বসিয়ে চলে এসেছেন অভিশপ্ত বাড়ির তলায়। স্বামী সত্যজিৎ সেনগুপ্ত মারা যাওয়ার পরে একা হাতে সংসার টানছেন। গত পাঁচ বছরে অনেক প্রতিশ্রুতি ছুঁয়ে গেছে তাঁর মাঝবয়সের জীবন। কিন্তু, বান্ধবী শিখা সরকারের মতো পাশে এসে কব্জি চেপে ধরেছেন হাতে গোনা কয়েক জন মানুষের মতো মানুষ। যিনি নিয়ম করে গত পাঁচ বছর ধরে চুপ করে স্টিফেন কোর্টের সামনে সাধনার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। এত বড় ঘটনা, যাকে ঘিরে এত হইচই, তার জন্য কলকাতা পুলিশের তরফ থেকে মাত্র ২ লক্ষ টাকার একটি চেক - সাকুল্যে এই ছিল ক্ষতিপূরণের ছবি।
তালিকা দীর্ঘ। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় ক্যামেরার পিছনে কাজ করেছেন অনিল ঘোষ। এখন চোখে ভাল দেখেন না। শৈলেনবাবুর মতো তাঁরও তরতাজা ছেলের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল ভয়াবহ সেই আগুন। অসহায় মানুষটার পাশে আজ সরকার নেই। তাঁর ২৭ বছরের ছেলে অঙ্কুশ যেখানে চাকরি করতেন, সেখান থেকে কোনও ক্ষতিপূরণ পাননি। চারু মার্কেটে থাকেন সমাজসেবী শম্পা সেনগুপ্ত। তিনিই সাহায্য করেছেন। এক সময়ে নিয়মিত অনিলবাবুর বাড়িতে চাল-ডাল পৌঁছে দিতেন শম্পাদেবী। কৃতজ্ঞ চিত্তে সেই সাহায্যটুকু ছাড়া সম্বলহীন বৃদ্ধ অনিলবাবু বলেন, “এখন যে রোজগার করব, সে ক্ষমতাও তো নেই। যে রোজগার করে মুখে অন্ন তুলে দিত, সে-ও নেই।”
যে সব সংস্থায় চাকরি করতেন স্বজনেরা, তাঁদের দরজায় গিয়ে অনেক কড়া নেড়েছেন অনিল, শৈলেন, ভাস্কর চক্রবর্তীরা। খালি হাতে ফিরতে হয়েছে বার বার। তা থেকেই জন্ম নিয়েছে আক্রোশ। ওঁরা প্রশ্ন তুলছেন, “কে বলবে আমাদের কথা? কে লড়বে আমাদের হয়ে?” এমনই এক সংস্থা রাওয়াত ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মালিক ব্রজেশ রাওয়াত ক্ষতিপূরণের প্রশ্নে কঠোর। বললেন, “আইনত আমি ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য নই। আমাদের পরিবারের সদস্যও সেখানে মারা গিয়েছেন। তবে মানবিক কারণে কেউ যদি চাকরি চাইতে আসেন, আমরা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করব। তাঁর যদি প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়, তা হলে তা-ও দেব।” কিন্তু, চোখে দেখতে না পাওয়া অনিলবাবু কী-ই বা প্রশিক্ষণ নেবেন, কী-ই বা কাজ করবেন?
অভিযোগ, যার এগিয়ে আসার কথা ছিল, সেই সরকারই হাত ধুয়ে ফেলেছে। সে দিনের বাম সরকার পুলিশকে দিয়ে সামান্য ক্ষতিপূরণ দিয়ে দায়িত্ব সেরেছে। এই সরকার চুপ করে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। গাফিলতির যে মামলা পাঁচ বছর আগে হয়েছিল, তারও বিচার এখনও শুরু হয়নি। শুধু কুরে কুরে খাচ্ছে সেই মানুষগুলোকে, যাঁদের কোনও না কোনও ভাবে ছুঁয়ে গিয়েছে সেই আগুনের উত্তাপ।
স্টিফেন কোর্ট-কাণ্ডে পুলিশের তদন্তকারী অফিসার ছিলেন দেবাশিস দত্ত। এ দিন তাঁর ফেসবুক পোস্ট, “চার দিকে ছড়িয়ে থাকা পোড়া দেহ, পচা মাংস আজও আমার আত্মাকে তাড়া করে বেড়ায়। ক্ষতিগ্রস্তদের সেই কান্না আজও মনে গেঁথে রয়েছে।”
দেবাশিস চ্যাটার্জি বাড়ি থেকে বেরোননি। মেয়ে পম্পার ও ভাবে চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেননি। বলেন, “ওই বাড়িটার সামনে গেলে যে বড় কষ্ট হয়।”