রমরমিয়ে ব্যবসা দত্তপুকুরে

অবৈধ বাজি কারখানায় আগুন, মৃত কিশোর

একই অপরাধ বারবার। বারবারই পেয়েছে জামিন। কিন্তু অপরাধের পথ থেকে সে সরেনি। চালিয়ে গিয়েছে বেআইনি বাজি তৈরির ব্যবসা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:০৯
Share:

ভস্মীভূত সেই বাজি কারখানা। (ইনসেটে) রাহুল দাস। সোমবার। — নিজস্ব চিত্র

একই অপরাধ বারবার। বারবারই পেয়েছে জামিন। কিন্তু অপরাধের পথ থেকে সে সরেনি। চালিয়ে গিয়েছে বেআইনি বাজি তৈরির ব্যবসা।

Advertisement

আট বছর আগে তার যে বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে তিন জনের প্রাণ গিয়েছিল। সেই কারখানাতে এ বার একই ভাবে প্রাণ গেল ১৪ বছরের এক কিশোরের। সোমবার ঘটনাটি ঘটেছে বারাসত সংলগ্ন দত্তপুকুর থানার নীলগঞ্জের নারায়ণপুরে।

আতস বাজির আড়ালে সখানে তৈরি হত শব্দবাজি। সেখানে কাজে যোগ দিতে গিয়েছিল ১৪ বছরের এক বালক। পুরোটাই বেআইনি, তাই তালা বন্ধ করেই কাজ চলছিল। হঠাৎ আগুন লেগে বিস্ফোরণ হলেও প্রাণ বাঁচাতে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেনি নবম শ্রেণির ছাত্র ওই কিশোর। পুলিশ জানায়, মৃত ওই কিশোরের নাম রাহুল দাস। এ দিনই প্রথম সেখানে ‘কাজে’ গিয়েছিল সে।

Advertisement

ঘটনার পরেই অবশ্য কারখানাটিকে ‘সিল’ করে মালিক জুলফিকর আলি মণ্ডলকে গ্রেফতার করেছে উত্তর ২৪ পরগনা পুলিশ। নষ্ট করা হয়েছে প্রচুর বাজির মশলাও। ২০০৮ সালে এই জুলফিকরের বাজি কারখানাতেই বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছিল তিন অপ্রাপ্ত বয়স্ক কারিগরের। আহত হয়েছিল আরও। সে সময়েও গ্রেফতার হয়েছিল জুলফিকর। পরে জামিন পেয়ে বেরিয়ে এসে চালিয়ে যায় বেআইনি বাজির কারবার।

প্রশ্ন উঠছে পুলিশের নজরদারি নিয়ে। স্থানীয় পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায়ের অবশ্য দাবি, ‘‘মাঝেমধ্যেই ওই এলাকায় হানা দিয়ে ধরপাকড় চলে। কারখানা ভেঙে দেওয়া হয়। জুন মাসেও জুলফিকরকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। জামিন পেয়েই সে ফের এই কাজ শুরু করে।’’

এত নজর থাকলে কী ভাবে চলছিল জুলফিকরের মতো আরও অনেকের এমন বেআইনি কারখানা, উঠছে সেই প্রশ্ন।

সূত্রের খবর, অনেকটা কুটির শিল্পের ধাঁচেই বাজি তৈরির কারখানা ছড়িয়ে ছিটিয়ে চলছে নীলগঞ্জের নারায়ণপুরে। বারুদের স্তূপের উপরে বসে থাকা এই এলাকায় দীপাবলির আগে বিস্ফোরণে মৃত্যু বা হাত-পা ঝলসে যাওয়ার মতো ঘটনা নতুন নয়। কাঁচা টাকার লোভ দেখিয়ে স্কুলের ছাত্র বা নাবালকদের কাজে লাগিয়ে মুনাফা লোটে জুলফিকরের মতো কারখানা মালিকেরা। এ দিনের ঘটনাও তা-ই সামনে আনল।

স্কুলে পুজোর ছুটি চলছে। নীলগঞ্জ শিক্ষায়তন হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র রাহুল তাই এ দিন সকালে পড়াশোনা শেষে বেরিয়েছিল বাড়ির পাশের মাঠে ফুটবল খেলতে। রাহুলের দাদা সোমনাথ জানান, মাঠে আনোয়ার আলি নামে এক কিশোর রাহুলকে দেড়শো টাকা মজুরির টোপ দিয়ে নিয়ে যায় জুলফিকরের বাড়িতে। একতলা পাকা বাড়িতে অবশ্য জুলফিকর বা তার পরিবারের কেউ ছিল না। নীচে এক কোনায় বাজির মশলার আড়ত। তার পাশেই তৈরি হয় চুরবুড়ি, চরকা, রং মশাল, কালি-পটকার আড়ালে চকোলেট বোমের মতো শব্দবাজিও। রাহুল ভিতরে ঢুকতেই ‘নিয়ম মাফিক’ তালা দিয়ে দেওয়া হয়।

এর মধ্যেই কোনও ভাবে কারখানায় আগুন লেগে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য, বেশ কিছুক্ষণ ধরে প্রচণ্ড শব্দে বাজি ফাটতে থাকে। বোমা বিস্ফোরণের মতো আলোর গোলা বাড়ি থেকে ছিটকে বেরোতে থাকে। পুলিশ জানিয়েছে, যারা কাজ করছিল, তাদের অধিকাংশই ছাদে উঠে লাফ দিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু একেবারে প্রথম দিন কাজে যাওয়া রাহুল কারখানা থেকে বেরোতে পারেনি। বাইরের তালা দেওয়ায় সে গ্রিল ঝাঁকিয়েও ভেঙে বেরোতে না পেরে ছাদের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সিঁড়ির কাছেই বিস্ফোরণে জখম হয়ে পড়ে ঝলসে যায় রাহুল। যত
ক্ষণে আগুন নেভে, তত ক্ষণে মৃত্যু হয়েছে ছেলেটির।

খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে যায় দত্তপুকুর থানার পুলিশ, দমকল। ওই বাড়ি এবং আশপাশের অন্য কারখানায় হানা দিয়ে প্রচুর বাজির মশলা নষ্ট করা হয়। দু’টি ম্যাটাডর করে ৩০০ কেজিরও বেশি বাজির মশলা বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যাওয়া হয়। এ দিকে, ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই প্রতিবেশীরা ভিড় করেন রাহুলের বাড়িতে। বাবা বাপি দাস পেশায় বাসচালক। মা লক্ষ্মীদেবী তখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না, ছেলে খেলা ছেড়ে বাজি কারখানায় ঢুকেছিল। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘‘কত বুঝিয়েছি ছেলেকে, কখনও ওই মৃত্যুপুরীতে ঢুকবি না। কিন্তু বাচ্চাদের এ ভাবে টাকার লোভ দেখালে মাথা ঠিক থাকতে পারে?’’

শুধু মৃত ছাত্রটির মা-ই নন, এ দিন স্থানীয় অনেকেই অভিযোগ করেন, এই এলাকা থেকে কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না বাজির কারখানা। কারখানার জন্য এলাকায় দুষণ হচ্ছে। বাচ্চাদের টাকার লোভ দেখিয়ে কাজ করানো হচ্ছে কারখানায়। পুলিশকে পয়সা আর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নেতাদের মোটা চাঁদা দিয়ে তাঁদের মুখ বন্ধ করে রাখছে বাজি কারখানার মালিকেরা। কোনও ঘটনা ঘটলে কিংবা দীপাবলির আগে পুলিশ এসে ‘লোক দেখানো’ কিছু বাজি বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে চলে যায়। একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে চললেও কী ভাবে এত বাজি কারখানা চলছে, প্রশ্ন তুলেছেন এলাকার মানুষই।

যদিও ঠিক কতগুলি বেআইনি কারখানা রয়েছে এলাকায়, তা জানাতে পারেননি স্থানীয় ইছাপুর-নীলগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান রেজিনাবিবি। শুধু বলেন, ‘‘প্রচুর কারখানা আছে। সবই বেআইনি।’’ কিন্তু তাঁরা কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? প্রধানের জবাব, ‘‘পুলিশ আসে, ভেঙে দিয়ে যায়। কিন্তু এরা শোনে না। ফের বসে পড়ে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement