অপটু হাতের বাজি থেকেই কি বিস্ফোরণ

দমকল ও পঞ্চায়েত দফতরের যাবতীয় অনুমতিপত্র সংগ্রহ করা হয়েছিল। বাজি তৈরি ও মজুত করার ছাড়পত্র-সহ সব ধরনের লাইসেন্স ছিল। ছিল অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থাও।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০১৮ ০১:২১
Share:

বিস্ফোরণের পরে বাজি কারখানা। রবিবার, সোনারপুরে।

দমকল ও পঞ্চায়েত দফতরের যাবতীয় অনুমতিপত্র সংগ্রহ করা হয়েছিল। বাজি তৈরি ও মজুত করার ছাড়পত্র-সহ সব ধরনের লাইসেন্স ছিল। ছিল অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থাও। কিন্তু দক্ষ কর্মী-কারিগরই রাখেনি সোনারপুরের গোবিন্দপুরের বাজি কারখানা ‘কালীমাতা ফায়ার ওর্য়াকস’। আনকোরা হাতে বাজি বানাতে গিয়েই রবিবার সেখানে বিস্ফোরণ ঘটে বলে প্রাথমিক তদন্তে অনুমান পুলিশকর্তাদের একাংশের।

Advertisement

দেড় বছর আগেও ওই কারখানায় এক বার বিস্ফোরণ হয়েছিল। তা সত্ত্বেও কেন দক্ষ কর্মী নিয়োগ করা হয়নি, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। কারখানার নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। সোমবার অকুস্থলে গিয়ে দেখা যায়, কারখানাটি সিল করে দেওয়া হয়েছে। বসেছে পুলিশ পিকেট। বারুইপুর জেলা পুলিশ সুপার অরিজিৎ সিংহ জানান, রাজ্য ফরেন্সিক দফতরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। মহালয়ায় ছুটি থাকায় এ দিন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা আসতে পারেননি। ফরেন্সিক টিমের তরফে নমুনা সংগ্রহের আগে পর্যন্ত ওই কারখানার দরজা বন্ধ রাখা হবে।

রবিবার রাতেই তল্লাশি চালানো হয় কারখানার অন্যতম মালিক তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে। নথিও মেলে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, বছর দেড়েক আগে বিস্ফোরণ ঘটার পরেও ওই কারখানা কী ভাবে ফের লাইসেন্স পেল? তদন্তকারীরা জানান, তরুণবাবু বড় ছেলে রঞ্জিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী মলি বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে লাইসেন্স নেওয়া হয়েছে। নথি বলছে, সে-বার বিস্ফোরণ ঘটেছিল কারখানার সামনের জমিতে। পরে পিছনের জমির দাগ নম্বর দেখিয়ে অর্থাৎ নাম ও জমির দাগ নম্বর হেরফের করেই ফের লাইসেন্স জোগাড় করা হয়।

Advertisement

কারখানার উল্টো দিকে তরুণবাবুর বাড়ি এখন ফাঁকা। তাঁর দুই ছেলে ও বৌমারা বেপাত্তা। পড়শিরা জানান, বাড়িতে বিদেশি প্রজাতির চারটি কুকুর ছিল। তাদেরও দেখা যাচ্ছে না। রবিবার রাতে ধৃত তরুণবাবুকে এ দিন বারুইপুর আদালতে তোলা হলে বিচারক তাঁকে ১৪ দিন জেল-হাজতে রাখার নির্দেশ দেন। তরুণবাবুর বয়স ৭০ ছুঁইছুঁই। তিনি অসুস্থ বলে জানিয়েছে পুলিশ।

তদন্তকারীরা জানান, স্থানীয় কমলিখালি, কোচপুকুর এলাকার শ্রমিকেরাই ওই কারখানায় কাজ করতেন। রবিবার জনা কুড়ি শ্রমিক কাজ করছিলেন। কয়েক জখম শ্রমিককে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশের ধারণা, সেখানে ‘শেল’ জাতীয় বাজি তৈরি হত। ওই ধরনের বাজি আকাশে ওঠার পরে বিকট আওয়াজ করে ফাটে। তার পরে নানা রঙের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ে। যে-সব বাজি আকাশে উঠে তীব্র শব্দে ফাটে, রবিবার সেগুলোই ঘরের মধ্যে পরপর ফাটতে থাকায় ভূমিকম্পের চেহারা নিয়েছিল। আশপাশের বাড়ির জানলার কাচ ভেঙে যায়। ওই সব বাজি তৈরিতে খুব কম পরিমাণে নাইট্রো গ্লিসারিন জাতীয় পদার্থ ব্যবহার করা হয়। সে-ক্ষেত্রে অনুপাত ঠিক রাখাটা জরুরি। প্রশ্ন উঠছে, অদক্ষ শ্রমিকদের সেই জ্ঞান ছিল কি? বেশি তাপমাত্রায় নাইট্রো গ্লিসারিন নিজে থেকেও বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে তদন্তকারীদের অভিমত। শেল তৈরিতে ছোট ছোট ধাতব গোলাকার বস্তু, মোমবাতির মতো এক ধরনের স্টিক লাগে। ঘটনাস্থলে তার নমুনা মিলেছে।

তদন্তকারীদের কথায়, এই ধরনের অতিদাহ্য বস্তুর মিশ্রণে বাজি তৈরির অনুমতি ওই কারখানাকে দেওয়া হয়েছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কারখানার অদূরে একটি বাড়িতে বাজি মজুত করা হত। প্রচুর শেল-সহ সেই গুদামের সব বাজিই বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

বিস্ফোরণে মৃত দেবাশিস সর্দার (১৯)-এর মা শিশুবালা সর্দার সোনারপুর দক্ষিণ বারুলির বাড়িতে বসে বলেন, ‘‘দোষীদের চরম শাস্তি চাই। আর কিছু ক্ষতিপূরণ পেলে ভাল হয়।’’ গত বছর থেকে পাড়ার পুজোর প্রতিমা দান করছেন দেবাশিসের বাবা মদন সর্দার। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘পুজোয় দেবাশিসের খুব উৎসাহ ছিল। ওর কথায় এ বারেও আমি একটি বেসরকারি ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার নিয়ে প্রতিমা তৈরি করাচ্ছি। কিন্তু ছেলেই তো আর রইল না!’’ দেবাশিসের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং ওই বাজি কারখানা বন্ধ করার দাবিতে এ দিন বিকেলে মিছিল করেন এলাকার বাসিন্দারা।

বিস্ফোরণে গুরুতর সারা শরীর ঝলসে গিয়েছে বিক্রম হালদারের। পরিবারের লোকেরা বন্ড সই করে সোমবার সন্ধ্যায় তাঁকে চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল মেডিক্যাল থেকে নিয়ে যান এসএসকেএমে। তাঁকে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করানো হয়েছে। আহত রঞ্জু হালদার আছেন ন্যাশনালেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement