ভিড়ে ঠাসা নিউ মার্কেট চত্বরে এ বার দেখা মিলবে মহিলা রক্ষীর। নিজস্ব চিত্র
মহিলা ক্রেতার সংখ্যা বেশি। মহিলা পকেটমার, কেপমারের সংখ্যাও রীতিমতো উল্লেখযোগ্য। অথচ এত দিন পর্যন্ত নিউ মার্কেটের নিরাপত্তা বলয়ে মহিলা নিরাপত্তারক্ষীদের কোনও ঠাঁই ছিল না। এই প্রথম শহরের অন্যতম প্রধান এই বাজারে মহিলা নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগ করতে চলেছে কলকাতা পুরসভা। মঙ্গলবার মেয়র পরিষদের বৈঠকে তেমনই প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এ দিন মেয়র পারিষদ (বাজার) আমিরুদ্দিন ববি বলেন, ‘‘মহিলাদের নিরাপত্তা ও সুবিধার কথা মাথায় রেখেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।’’
সারা বছর ধরে নিউ মার্কেটে আসা ক্রেতাদের উপরে একটি সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছে যে, ক্রেতাদের অধিকাংশই মহিলা। কিন্তু ওই মার্কেটে বর্তমান নিরাপত্তারক্ষীদের সকলেই পুরুষ। অন্তর্বর্তী সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, নিউ মার্কেট চত্বরে মহিলা ক্রেতাদের কোনও অসুবিধা হলে তাঁরা নিঃসঙ্কোচে গিয়ে কোনও পুরুষ নিরাপত্তারক্ষীকে সে কথা বলতে পারছেন না। পুর আধিকারিকদের একাংশ জানাচ্ছেন, স্যার স্টুয়ার্ট হগ মার্কেট ওরফে নিউ মার্কেটে ক্রেতার সংখ্যা পর্যালোচনা করে দেখা গিয়েছে, মার্কেট চত্বরে প্রায় ২,৬০০ দোকানে সারা বছর মহিলা ক্রেতাদের সবচেয়ে বেশি আনাগোনা। কিন্তু মার্কেট চত্বরে ভিড়ের মধ্যে কোনও অবাঞ্ছিত ঘটনার মুখোমুখি হলে, এমনকি শারীরিক ভাবে হেনস্থা হলেও বহু ক্ষেত্রেই কোনও মহিলা ক্রেতা সে সম্পর্কে পুরুষ নিরাপত্তারক্ষীকে জানাতে পারছেন না। কারণ, সব মহিলা অতটা সাহসী নন অথবা সঙ্গে সঙ্গে অবাঞ্ছিত ঘটনার প্রতিবাদ করতে পারেন না। দ্বিধা কাটিয়ে পুরুষ নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে গিয়ে তাঁরা পুরো ঘটনার কথা সব সময়ে বলতে পারেন না। ফলে সেই সমস্ত অবাঞ্ছিত ঘটনার অভিযোগও দায়ের করা হয় না বলে পুর প্রশাসন সূত্রের খবর।
একই সমস্যার কথা বলছেন মার্কেটের ব্যবসায়ীরাও। ‘এস এস হগ মার্কেট শপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক জায়েদ (বাবলু) আলমের কথায়, ‘‘অনেক সময়েই দেখতে পাই, পুরুষ বিক্রেতারা দুর্ব্যবহার করছেন মহিলা ক্রেতাদের সঙ্গে। অনেক অসভ্যতার ঘটনাও ঘটে। অনেকেই তার প্রতিবাদ করতে পারেন না মুখের উপরে। পুরুষ সিকিউরিটি গার্ডদেরও জানাতে পারেন না। মহিলা নিরাপত্তারক্ষী হলে তো সুবিধাই হয়।’’
সমস্যা এখানেই শেষ নয়। মহিলা পকেটমার ও কেপমারেরাও নিউ মার্কেট চত্বরে ঘোরাফেরা করে বলে জানাচ্ছেন পুর আধিকারিকদের একাংশ। ভিড়ের সুযোগে এই মহিলারা ক্রেতা সেজে অন্যদের থেকে মোবাইল বা পার্স চুরি করে। পুলিশ কড়া নজরদারি চালালেও মার্কেট চত্বর এতটাই বড় যে, সব সময়ে এ ধরনের ঘটনা আটকানো যায় না। অনেক সময়ে পুরুষ নিরাপত্তারক্ষীরাও সঠিক পদক্ষেপ করতে পারেন না। ফলে মহিলা পুলিশ আসার আগেই কাজ সেরে এলাকা ছেড়ে চম্পট দেয় ওই মহিলা অপরাধীরা। সাম্প্রতিক অতীতে এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা নজরে পড়েছে পুর প্রশাসনের।
পুরকর্তারা বলছেন, নিউ মার্কেটের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। আর তাই শহরের এই বাজারটির প্রতি তাঁদেরও বিশেষ নজর। ‘নেটিভ’দের সঙ্গে একসঙ্গে বাজারে প্রবল অনীহা ছিল ব্রিটিশদের, আর তাতেই জন্ম নিয়েছিল নিউ মার্কেট! ১৮৭১ সাল থেকেই কলকাতার ব্রিটিশরা এই দাবিতে সরব হয়েছিলেন যে, শুধুমাত্র তাঁদের জন্য একটা পৃথক মার্কেট তৈরি করা হোক। যে দাবিতে নড়েচড়ে বসেছিল কলকাতা (তখন ক্যালকাটা) পুরসভাও। উঠে পড়ে লাগেন পুরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান স্যার স্টুয়ার্ট হগও। তাঁর উদ্যোগকে সম্মান জানিয়েই নির্মাণের ২৮ বছর পরে, অর্থাৎ ১৯০৩ সালে মার্কেটের নামকরণ হয়েছিল স্যার স্টুয়ার্ট হগের নামে। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মার্কেটের নকশা তৈরির জন্য। শেষ পর্যন্ত ১৮৭৪ সালের পয়লা জানুয়ারি নতুন মার্কেট চালু হয়! সেই শুরু। তার পর শহরের সঙ্গে মার্কেটের ইতিহাসও তাল মিলিয়ে এগিয়েছে। নিউ মার্কেটের বর্তমান বয়স ১৪৫ বছর!
পুরসভা সূত্রের খবর, নিউ মার্কেটের যে সমস্ত জায়গায় মহিলা নিরাপত্তারক্ষী প্রয়োজন, তা ইতিমধ্যেই চিহ্নিত করা হয়েছে। এক পদস্থ পুর আধিকারিক বলেন, ‘‘যে সংস্থা নিরাপত্তারক্ষীদের নিয়োগের দায়িত্বে রয়েছে, তাদের বলা হয়েছে হগ মার্কেটের জন্য পুরুষদের পাশাপাশি মহিলা নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগের ব্যবস্থা করতে। প্রাথমিক ভাবে মার্কেটের একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে এই প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।’’ পরীক্ষামূলক ভাবে প্রথমে তিন জন মহিলা নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগ করা হবে। তার পরে ধাপে ধাপে পুরো মার্কেটেই মোতায়েন করা হবে ওই মহিলা নিরাপত্তারক্ষীদের।