—প্রতীকী চিত্র।
সরু, আঁকাবাঁকা রাস্তা এক জায়গায় শেষ হয়ে গিয়েছে। এক দিকে ছোট মাঠ। অন্য দিকে ডোবা। মহেশতলায় নন্দরামপুর দাসপাড়ার এই পর্যন্ত পৌঁছনো গেলেও বোঝার উপায় নেই, বাজি ক্লাস্টার তৈরি হচ্ছে কোথায়! অথচ, পাড়ার মোড়ে মোড়ে বাজির দোকান। সেখানে বিক্রি করার মতো বাজিও ঠাসা। বাড়ির উঠোনে শুকোতে দেওয়া হয়েছে বাজি।
কিন্তু ক্লাস্টার?
এক স্থানীয় বাসিন্দা ডোবা দেখিয়ে বললেন, ‘‘এটাই তো বোজানো যাচ্ছে না। দমকলের তরফে বলে দেওয়া হয়েছে, ২০ ফুট চওড়া রাস্তা না হলে এখানে বাজির ক্লাস্টার করার অনুমতি দেওয়া যাবে না। দমকলের গাড়িও ঢুকবে না। কবে ক্লাস্টার হবে কে জানে!’’ এর পরেই তাঁর মন্তব্য, ‘‘এই জটিলতায় তো পুজোর ব্যবসা মার খেতে দেওয়া যায় না। বাড়িতেই বাজি তৈরি করছি।’’
কিন্তু, এ ভাবে বাজি বানাতে গিয়েই আবারও বিস্ফোরণ ঘটে গিয়েছে কোলাঘাটের পয়াগে। পর পর এমন ঘটনায় একাধিক মৃত্যুর পরেও ফের একই জিনিস হওয়ায় প্রশ্ন উঠে গিয়েছে পুলিশ-প্রশাসনের নজরদারি নিয়ে। অনেকেই বলছেন, এই মুহূর্তে সব ধরনের বাজি তৈরি বন্ধের নির্দেশ থাকলেও এ সব হচ্ছে কী ভাবে? শুধু কোলাঘাটের ওই এলাকাই নয়, বাজি মহল্লা হিসাবে পরিচিত মহেশতলার নুঙ্গি, চম্পাহাটি, বারাসতের নারায়ণপুর— সর্বত্র এক অবস্থা। অভিযোগ, সব রকম নির্দেশ উড়িয়ে এই সব তল্লাটে দেদার বেআইনি বাজি তৈরি হচ্ছে। দুর্ঘটনাও ঘটছে যখন তখন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বড় কিছু না ঘটলে ‘খবর’ বাইরে আসে না। স্থানীয় নেতা-দাদা থেকে প্রশাসনেরই একাংশের মদতে বেলাগাম এই বাজি ব্যবসা চলছে বলে অভিযোগ। এমনকি, অতীতে বাজি বিস্ফোরণে মৃত্যু ঘটেছে, এমন বাড়ির আশপাশেও দেদার বাজি তৈরি হচ্ছে।
জানা গেল, এই মুহূর্তে বাজি কারবারিদের মূল ব্যস্ততা পুজোর বাজার ধরার। বাজি তৈরির প্রচুর উপকরণ আনিয়ে কাজ সেরে ফেলা হচ্ছে। কাজ করছেন মহিলা ও শিশুরাও। নির্বাচনের পরে নজরদারি কিছুটা কমেছে। সেই সুযোগে তৈরি বাজি লরিতে ভরে ভিন্ রাজ্যে পাঠিয়ে দেওয়াও শুরু হয়ে গিয়েছে। তৈরি হওয়া বিপুল পরিমাণ বাজি মজুত রাখা হচ্ছে জনবসতির মধ্যে ঘর ভাড়া নিয়ে। মহেশতলার বাজি কারবারি নিমাই ঘোষ বললেন, ‘‘দুর্গাপুজোর আর ১১৯ দিন বাকি। তার পরেই কালীপুজো। বরাত অনুযায়ী তৈরি বাজি সারা ভারতে পৌঁছে দিতে হয়। তাই রাত-দিন কাজ হচ্ছে।’’
কিন্তু, এই মুহূর্তে রাজ্যে তো কোনও বাজি তৈরি হওয়ারই কথা নয়! ‘পশ্চিমবঙ্গ বাজি শিল্প উন্নয়ন সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক শুভঙ্কর মান্নার দাবি, ‘‘এই রাজ্যে কলকাতা হাই কোর্ট শুধুমাত্র সবুজ বাজি তৈরি এবং বিক্রিতে ছাড় দিয়েছে। যার অর্থ, বাকি সমস্ত বাজিই বেআইনি। আর সবুজ বাজিতেও কিউআর কোড থাকা বাধ্যতামূলক।’’ জানা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে রাজ্যে তো বটেই, দেশের কোনও বাজি প্রস্তুতকারী সংস্থার কাছেই বৈধ কিউআর কোড নেই। কারণ, দেশে বাজি তৈরির ছাড়পত্র দেওয়ার সংস্থা ‘ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ বা নিরি-র কোনও কিউআর কোডই এখন আর কার্যকর নেই। নিরি-র হয়ে যে সংস্থা কিউআর কোড তৈরি করত, তাদের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে নিরি-র। নানা জটিলতায় সেই কোড তৈরির বরাত আর নবীকরণ করা হয়নি।
এ বিষয়ে নিরি-র এক আধিকারিকের মন্তব্য, ‘‘কিউআর কোড স্ক্যান করার পুরনো মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন খুলতে সমস্যা হচ্ছিল নতুন অ্যান্ড্রয়েড ব্যবস্থায়। বহু বাজির ক্ষেত্রে কোড স্ক্যান করার পরেও নিরি-র ছাড়পত্রের প্রতিলিপি খোলা যাচ্ছিল না। বিভিন্ন স্তর থেকে অভিযোগ পেয়ে আর চুক্তি নবীকরণ করা হয়নি।’’
নিরি সূত্রের খবর, যে হেতু পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া অন্য রাজ্যে শুধুমাত্র সবুজ বাজিই তৈরি এবং বিক্রি করার এই কড়াকড়ি নেই, আর কিউআর কোড থাকা বাধ্যতামূলকও নয়, তাই এই নিয়ে দরপত্র ডেকে নতুন সংস্থাকে বরাত দেওয়ার তাগিদও চোখে
পড়ছে না। এই সুযোগেই পুজোর আগে ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় দেদার তৈরি হচ্ছে বেআইনি বাজি। সে সব মজুতও করা হচ্ছে বসতি এলাকার মধ্যেই।