কলকাতার শ্রীঅরবিন্দ ভবনের মূল উদ্যোগে ২০১৬ সাল থেকে পুরনো কলকাতা বিষয়ক বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছে নানা সময়ে, ‘কলকাতা কথকতা’-র সঙ্গে যৌথ প্রয়াসে। বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি-চর্চায় ও বিশেষ করে সংগ্রহের পরিসরে কলকাতা কথকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ দল। এ শহরের প্রায় তিরিশ জন সংগ্রাহক যুক্ত এখানে, তাঁদের সঙ্গে আছেন বিশিষ্ট গুণীজনও। কলকাতা, সংরক্ষণ ও শিল্পের নানা বিষয়ে কলকাতা কথকতা নামে বার্ষিক পত্রিকাও প্রকাশ করে এই দল।
আগামী ৬ থেকে ৯ অক্টোবর, বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত তারা আয়োজন করেছে বার্ষিক প্রদর্শনী, ‘সার্ধশতবর্ষে শ্রীঅরবিন্দ ও সমসাময়িক দেশ-কাল সমাজ এবং ফিরে দেখা: সত্যজিৎ রায়’। অরবিন্দের জন্মের সার্ধশতবর্ষ পেরিয়ে গেল সম্প্রতি, সত্যজিৎ- জন্মশতবর্ষ চলে গিয়েছে অতিমারির বছরে। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধায়, বত্রিশ জন সংগ্রাহক ও আরও পাঁচ জন আমন্ত্রিত গুণিজন অংশগ্রহণ করছেন প্রদর্শনীতে। অরবিন্দকে ঘিরে চমকপ্রদ সংগ্রহ: শ্রীঅরবিন্দ ও শ্রীমার ব্যবহৃত নানা জিনিস, দুষ্প্রাপ্য নথি, বই, পত্রিকা, চিঠি, আলিপুর বোমা মামলার নথি দেখা যাবে, সেই সঙ্গে বারীন্দ্র ঘোষ, হেমচন্দ্র কানুনগো, রাজনারায়ণ বসু, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখের লেখা চিঠিও। ১৯৪৯ সালে বিমলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে হাজরা পার্কে আয়োজিত হয় শ্রীঅরবিন্দ আবির্ভাব মহোৎসব, ভারতে প্রথম। তারও যাবতীয় নথিপত্র থাকছে প্রদর্শনীতে। আনন্দবাজার পত্রিকা-সহ সংবাদপত্রে অরবিন্দ-প্রয়াণের খবর (মাঝের ছবি), অরবিন্দের স্বাক্ষরিত বই, তাঁকে নিয়ে প্রকাশিত মুদ্রা ও ডাকটিকিটও দেখা যাবে।
সত্যজিৎ রায় ঘিরে সংগ্রহও দেখার মতো। ছবির পোস্টার লবি-কার্ড বুকলেট; সোনার কেল্লা ঘরে বাইরে সীমাবদ্ধ ছবির চিত্রনাট্যের অংশ, একেই বলে শুটিং বইয়ের ভূমিকার পাণ্ডুলিপি; নিজের হাতে করা বইয়ের ডামি, ওঁর ডিজ়াইন করা বিয়ের চিঠি দেখার সুযোগ। সত্যজিতের লেখা চিঠি, শংসাপত্র, নিজের হাতে লেখা প্রিয় ছবির তালিকা, আঁকা ছবি ও ক্যালিগ্রাফি (উপরে বাঁ দিকে) ছাড়াও বিশেষ আকর্ষণ ওঁর নানা ছবিতে ব্যবহৃত নানা ‘প্রপ’: হীরক রাজার দেশে-র দোতারা (উপরে ডান দিকে), জয় বাবা ফেলুনাথ-এর গোল তাস (উপরে মাঝের ছবি), আইভরির পেজ-মার্ক, গণশত্রু ছবির খবরকাগজ ও নোটিস বোর্ডের বিজ্ঞপ্তি, চিড়িয়াখানা-র টেলিফোন (উপরে বাঁ দিকে)। জলসাঘর ছবি যে ক্যামেরায় তোলা হয়েছিল, সেটি থাকবে অরোরা ফিল্মস-এর সৌজন্যে, ডি আর মেকআপ-এর তরফে গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবির রুদ্রবীণাটি। থাকবে নিমাই ঘোষ ও অসিত পোদ্দারের তোলা সত্যজিতের আলোকচিত্রও। জীবনকৃতি সম্মানে ভূষিত হবেন শেখর চক্রবর্তী, উৎপল সান্যাল ও তাপস কুমার বসু, তিন সংগ্রাহক।
অমূল্য
অতুলপ্রসাদ সেন ও রাধাকমল মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়, প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মিলন তথা নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন-এর মুখপত্র উত্তরা-র যাত্রা শুরু ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১ আশ্বিন, লখনউ থেকে। প্রথম সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের (ছবি) আশীর্বাণী, প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন অসিতকুমার হালদার। বছরকয়েক চলার পর বন্ধ, পরে সুরেশ চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ফের প্রকাশ পায় বারাণসী থেকে। ১৯২৫-১৯৬৭, ৪২ বছরের যাত্রায় পত্রিকার বড় অংশ জুড়ে ছিল রবীন্দ্রকবিতা-গান-প্রবন্ধ চিঠি। রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে তা থেকে সুরেশ চক্রবর্তী কিছু রবীন্দ্র-রচনা ও রবীন্দ্র-বিষয়ক রচনা বেছে প্রকাশ করেন উত্তরা রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী সংখ্যা। এ বার তারই প্রতিলিপি সংস্করণ বেরোল অমরনাথ করণের সঙ্কলন ও টীকায়, (প্রকা: লালমাটি), গত ২২ সেপ্টেম্বর। রবীন্দ্রনাথ অতুলপ্রসাদ নজরুল কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় দিলীপকুমার রায়-সহ গুণিজনের লেখায় ঋদ্ধ, অমূল্য।
একে দুই
বাদল সরকারের নাটক বল্লভপুরের রূপকথা দিয়ে পঁচিশ বছর আগে যাত্রা শুরু করেছিল শৈলিক নাট্যদল। সেই প্রযোজনার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন ভি বালসারা কুমার রায় প্রদীপ ঘোষের মতো নাম। সেই শ্রদ্ধেয়দের স্মরণে, বল্লভপুরের রূপকথা-র নবতম মঞ্চায়নের মধ্য দিয়েই দলের পঁচিশ বছর পূর্তির উদ্যাপন করল তারা, গত ২৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় রবীন্দ্র সদনে, প্রবীরবরণ বসুর পরিচালনায়। নাটকেই শেষ নয়, সন্ধ্যার আরও এক আকর্ষণ ছিল চৌরঙ্গী পত্রিকার ‘জোছন দস্তিদার সংখ্যা’, অনুষ্ঠানের প্রথমার্ধে যা প্রকাশ পেল বিশিষ্টজন-উপস্থিতিতে। প্রায় পাঁচশো পাতার পত্রিকায় জোছন দস্তিদারের সাক্ষাৎকার, তাঁকে নিয়ে অন্তরঙ্গজনের স্মৃতিচারণ, প্রবন্ধ-নাটক-কবিতাও। মুদ্রিত প্রায় পঞ্চাশটি ছবিও।
আর্কাইভ নিয়ে
যৌথ স্মৃতি সংরক্ষণে জরুরি ভূমিকা আর্কাইভের; নথি বইপত্র ফোটোগ্রাফ পাণ্ডুলিপি-সহ নানা উপাদানে গড়ে ওঠা আর্কাইভ সামাজিক-সাংস্কৃতিক গবেষণারও ভিত। সর্বসাধারণের ব্যবহারযোগ্য আর্কাইভ দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম গড়ে তোলে সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস কলকাতা, তাদের ডিজিটাল আর্কাইভ বাংলা অসমিয়া উর্দু ফার্সি-সহ নানা ভাষার বই ও উপাদানে সমৃদ্ধ। আর্কাইভের ত্রিশ ও সেন্টার-এর পঞ্চাশ বছর উদ্যাপনে আয়োজিত বক্তৃতামালার প্রথম পর্বে আর্কাইভের অতীত-বর্তমান, ভবিষ্যতের রূপরেখা নিয়ে বলবেন অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী, রাহি সোরেন ও অভিজিৎ ভট্টাচার্য, অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঞ্চালনায়। বৈষ্ণবঘাটা পাটুলিতে সেন্টার-এর সভাকক্ষে, ৬ অক্টোবর শুক্রবার, দুপুর ৩টেয়।
গীত চর্চা
সঙ্গীতপ্রেমী ও সঙ্গীতশিল্পীদের এক সঙ্গে পথ চলার জরুরি কাজটি যদি একটি সংগঠনের ছাদের তলায় হয়, জন ও মন দুইয়েরই বল-ভরসা বাড়ে তাতে। ২০১৮ সালে সেই লক্ষ্যেই গড়ে ওঠে ‘মিউজ়িক অ্যাসোসিয়েশন হাওড়া’, শুরুতে সাড়া দেন চল্লিশেরও বেশি শিল্পী, এখন সদস্য ছাড়িয়েছে একশো। হাওড়ার গুণী শিল্পীদের প্রচারের আলোয় নিয়ে আসা, পরিচয় করিয়ে দেওয়া লক্ষ্য, তবে সেখানেই শেষ নয়। তাঁরা উদ্যোগ করেছেন গান ঘিরে নানা চর্চারও: অনুষ্ঠান, প্রতিভা সন্ধান, কর্মশালা। তারই অঙ্গ হিসেবে গত ২৪ সেপ্টেম্বর বোধোদয় ইন্টারন্যাশনাল স্কুল কুসুম মঞ্চে হয়ে গেল রবীন্দ্রসঙ্গীত ও বাংলা গানের কর্মশালা, অগ্নিভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে।
ইতিহাস, স্মৃতি
স্বল্প ব্যবধানে দু’টি বইয়ের প্রকাশ থিমা-র। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কী ভাবে এক প্রশাসনিক ইমারত গড়ে তুলল— শাসনযন্ত্র চালাতে ভারতীয় ও ইউরোপীয় কর্মচারীদের চাকরিতে বহাল করা, ছুটির হিসাব, পেনশন, সব নিয়ে তৈরি করল জটিল বহুস্তরীয় প্রশাসন— তা-ই আছে শর্মিষ্ঠা দে’র বইয়ে, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট ইন দ্য ডেজ় অব জন কোম্পানি: ১৭৯০-১৮৫০। লেখিকা রাজ্য অভিলেখ্যাগারের দীর্ঘকালের কর্মী। গত ২৩ সেপ্টেম্বর যদুনাথ ভবনে বই-প্রকাশে ছিলেন রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায় শৌভিক মুখোপাধ্যায় ও উৎপল চক্রবর্তী। আর গত ২৫ সেপ্টেম্বর উদয় সদনে শবরী মিত্র ও শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থাপন করলেন প্রয়াত প্রাণী-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক জগন্ময় মিত্রের ঝরাপাতার কথকতা। সেকালের গ্রামীণ ও নাগরিক জীবন বিধৃত তাঁর আত্মকথায়, ছেচল্লিশের দাঙ্গাও।
শিল্পসেতু
বঙ্গভূম ও জাপান, দুই মাটির সংযোগসেতু যদি ধরা যায় শিল্পকে, দেখা যাবে তার ইতিহাসটি বন্ধুতা আর বিনিময়ের। ওকাকুরা-রবীন্দ্রনাথ সংযোগ, জোড়াসাঁকোয় অবনীন্দ্রনাথ-গগনেন্দ্রনাথের কাছে চিত্রশিল্পী টাইকান ও হিশিদার আসা-যাওয়া, ছবি-আঁকা, নতুন আঙ্গিক চর্চা, শেখা আর শেখানোর ইতিবৃত্ত সেই ইতিহাসেরই অঙ্গ। সময় পাল্টেছে, রয়ে গেছে শিল্পসেতুটি। এই সময়ের জাপানি চিত্রশিল্পী মিসাকো শিনে কাজ করেন জাপানি ধ্রুপদী ইঙ্ক-পেন্টিংয়ের পরিসরে। প্রায়ই আসেন ভারতে, বাংলাতেও— সেই সূত্রেই যোগাযোগ শান্তিনিকেতনের নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে, জাপানি শৈলীতে প্রাণিত হয়ে যিনি চর্চা করেন ‘কার্সিভ’ বাংলা ক্যালিগ্রাফি। গ্যালারি চারুবাসনায় তাঁদের দু’জনের প্রদর্শনী ‘দ্য ম্যাজিক ব্রাশ’ চলছে গত ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে, আজ শেষ দিন, দুপুর ২টো থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। জাপানি ইঙ্ক-পেন্টিং নিয়ে দু’দিন কর্মশালাও পরিচালনা করলেন মিসাকো।
অজিতেশ ৯০
এই সময়ে কে কী ভাবে মনে রেখেছেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে? তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, আশ্চর্য চাহনি, দরাজ হাসির অনুষঙ্গে? তাঁর নাটক লেখা, থিয়েটারে অসামান্য অভিনয় আর নাট্যনির্দেশনার মধ্য দিয়ে? সিনেমার পর্দা, বেতার নাটক থেকে যাত্রার আসরে তাঁর উদাত্ত উপস্থিতির স্মৃতিতে? বামপন্থী ভাবনা আর বিশ্বাসেরও ও-পারে তাঁর মানবদর্শন, মানবিক বোধের সূত্রে? এই সব ভাবনাই আরও এক বার উস্কে দিয়ে এসে গেল অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (ছবি) জন্মদিন। আজ, ৩০ সেপ্টেম্বর নব্বই পূর্ণ করলেন তিনি। ৯১তম জন্মদিন উদ্যাপন করছে ‘কথাকৃতি’, বাগবাজার রিডিং লাইব্রেরি হল-এ আজ সন্ধ্যা ৬টায়। অজিতেশের বিখ্যাত নাটক সওদাগরের নৌকা-র নির্বাচিত অংশের পাঠ-অভিনয়, সেই সঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর কাব্যনাট্য সংক্রান্তি-র পাঠ-অভিনয়ও। সুব্রত ঘোষ ও মলয় রক্ষিত বলবেন ‘থিয়েটার দেখা: নাট্যদর্শিতা’, এবং শিল্পীর জীবনকৃতি নিয়ে।
নিষ্ঠার নাম
স্পোর্টিং ইউনিয়নে সতীর্থ গোপাল বসু, দিলীপ দোশিদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার সূত্রে বড় অফিসের চাকরি জুটেই গিয়েছিল প্রায়। তারও আগে সাঁতারের ব্যাকস্ট্রোকে জুনিয়র বেঙ্গলে নির্বাচিত হয়েও বাবার নিষেধ থাকায় যেতে পারেননি। সত্তরের দশকে জ্যেষ্ঠ পুত্র ডানপিটে ‘বাপি’কে ‘দক্ষিণী’-র প্রশাসনে ঢুকিয়ে দিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ শিক্ষক, শিল্পী খোঁজার জহুরি শুভ গুহঠাকুরতা। সে দিন যে ইতিহাস সূচিত হয়েছিল, প্লাটিনাম জুবিলির বছরে থমকে গেল তা। গত ২৬ সেপ্টেম্বর চলে গেলেন সুদেব গুহঠাকুরতা, বয়স আশি না ছুঁতেই। ‘ডিসিপ্লিন’ শব্দটির পাশে আর কোনও কিছুকে স্থান দেননি, বড় নামের পিছনে ছোটেননি কদাপি। তাঁর সনিষ্ঠ শিক্ষায় শ্রোতারা পেয়েছেন বহু গরীয়ান গাইয়েকে। দক্ষিণী-র সম্মেলক আসলে শৃঙ্খলা নামের মুদ্রাটিরই অপর পিঠ, পাঁচ দশক জুড়ে যাঁর অন্যতম স্থপতি তিনি। জীবন-মৃত্যুর লড়াই চলেছে যখন, তখনও বন্ধ থাকেনি দক্ষিণী-র স্বাভাবিক ক্লাস; অসুস্থতার কথা ফলাও করেননি কখনও। প্রতিষ্ঠানের গৌরববর্ষে সাঙ্গ হল গানের পালা।