ব্যাঙ্কশাল কোর্টে অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। রবিবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
তাঁর ফ্ল্যাটে খোঁজ মিলেছে টাকার পাহাড়ের। সঙ্গে বিপুল পরিমাণ সোনার গয়না আর বিদেশি মুদ্রার। মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত সেই অর্পিতা মুখোপাধ্যায়কে এ বার বেআইনি নিয়োগের অন্যতম চক্রী বলে দাবি করল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। শুধু তা-ই নয়, শনিবার সন্ধ্যায় গ্রেফতার হওয়া অর্পিতার বাড়িই স্কুলে বেআইনি নিয়োগের আখড়া বা কেন্দ্রস্থল (এপিসেন্টার) ছিল বলে রবিবার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের (সিএমএম) আদালতে জানাল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটি।
রবিবার কলকাতা সিএমএম আদালতে অর্পিতাকে তুলে ইডি-র দাবি, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী (বর্তমানে শিল্পমন্ত্রী) পার্থের ‘ঘনিষ্ঠ’ এই মডেল-অভিনেত্রী যথেষ্ট ‘প্রভাবশালী’। স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি) ও প্রাথমিক টেট-এ নিয়োগ-দুর্নীতির তিনি অন্যতম মূল চক্রী। টালিগঞ্জের ডায়মন্ড সিটি সাউথে অর্পিতার ফ্ল্যাট আদপে স্কুলে বেআইনি নিয়োগের ‘এপিসেন্টার’ (কেন্দ্রস্থল)। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটির অভিযোগ, অর্পিতার ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালিয়ে শিক্ষা দফতরের নিয়োগের বিভিন্ন নথি উদ্ধার হয়েছে। তার মধ্যে এসএসসি, গ্রুপ-ডি ও নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে শিক্ষক নিয়োগের নথি রয়েছে। ইডি-র প্রশ্ন, এই সব নথি সরকারি দফতরে থাকার কথা। তা ওই ফ্ল্যাটে এল কী করে?
‘মিনিস্টার ইন-চার্জ এডুকেশন’ লেখা বেশ কয়েকটি খালি খামও পাওয়া গিয়েছে অর্পিতার ফ্ল্যাট থেকে। তদন্তকারীদের প্রাথমিক ভাবে অনুমান, অনেক ক্ষেত্রে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীকে ওই খামে করে বেআইনি নিয়োগের সুপারিশপত্র পাঠানো হয়েছিল। পরে তা চলে আসে অর্পিতার ফ্ল্যাটে। ইডি সূত্রে দাবি, বিভিন্ন নিয়োগের ক্ষেত্রে চাকরিপ্রার্থীদের পূর্ণ তালিকা এবং পরীক্ষা সংক্রান্ত নানা নথিও অর্পিতার হেফাজত থেকে পাওয়া গিয়েছে।
এ দিন অর্পিতাকে এক দিনের জন্য ইডি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন বিচারক। আজ, সোমবার তাঁকে সিবিআই ও ইডি-র বিশেষ আদালতে তোলার কথা। অর্পিতার কাছ থেকে যে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে, তা নিয়ে আলাদা মামলা করার কথাও ভাবছে ইডি। কোথা থেকে তিনি এত বিদেশি মুদ্রা পেলেন, তা জানতে চান তদন্তকারীরা। অর্পিতা অবশ্য এ দিন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বলেন, ‘‘আইনের উপরে আস্থা রাখি। আইন আইনের পথে চলবে।’’ সেই সঙ্গে তাঁর দাবি, ‘‘আমি কোনও পার্টি (দল) করি না। ...আমার মায়ের খেয়াল রাখবেন।’’ যদিও নির্দিষ্ট কাউকে উদ্দেশ্য করে তিনি সে কথা বলেননি।
এই মামলায় ইডি-র তদন্তকারী অফিসার মিথিলেশ কুমার মিশ্র এ দিন আদালতে দাবি করেন, অভিযুক্ত অর্পিতা পার্থের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। টালিগঞ্জের করুণাময়ীতে অর্পিতার ডায়মন্ড পার্কের ফ্ল্যাটে নিয়মিত যাতায়াত ছিল মন্ত্রীর। ওই ফ্ল্যাট থেকেই উদ্ধার হয়েছে ২১ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা। শনিবার ইডি জানিয়েছিল, প্রায় সাড়ে ২২ কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে। কিন্তু, রবিবার সকালে তদন্তকারী সংস্থাটি জানিয়েছে, চূড়ান্ত গণনার পরে সেই অঙ্ক ২১ কোটি ৯০ লক্ষ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
পার্থের সঙ্গে অর্পিতার একটি নির্দিষ্ট মোবাইল ফোনে প্রায় প্রতিদিন কথাবার্তা হত বলেও তদন্তে উঠে এসেছে। মন্ত্রীর বাড়ি থেকে অর্পিতার নামে বিভিন্ন সম্পত্তির দলিল ও সংস্থার নথি উদ্ধার হয়েছে বলেও তদন্ত রিপোর্টে অভিযোগ। তদন্তকারী অফিসারের দাবি, প্রাথমিক ভাবে উঠে আসা তথ্যের ভিত্তিতে অর্পিতার ফ্ল্যাট কার্যত বেআইনি নিয়োগের কার্যালয়ে পরিণত হয়েছিল বলে মনে করা হচ্ছে। তাঁর কাছ থেকে একটি ছোট কালো ডায়েরি পাওয়া গিয়েছে। ওই ডায়েরির ৩০টি পাতায় থাকা বহু তথ্য দুর্নীতি-তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য হিসেবে উঠে এসেছে বলেও ইডি-র দাবি। যে বিপুল পরিমাণ সোনার গয়না অর্পিতার ফ্ল্যাট থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, তার দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে।
রবিবার আদালতে ইডি-র আইনজীবী অভিজিৎ ভদ্র বলেন, ‘‘অর্পিতা অত্যন্ত প্রভাবশালী। মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ। তাঁর বাড়ি থেকে বেআইনি নিয়োগের একাধিক তথ্য-প্রমাণ, বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা, বিদেশি মুদ্রা এবং গয়না উদ্ধার হয়েছে। বেআইনি নিয়োগে তিনি অন্যতম চক্রী। দুর্নীতি চক্রে আরও প্রভাবশালীরা জড়িত রয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। ধৃতকে জেরা করে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের শিকড়ে পৌঁছানো প্রয়োজন। তাই ধৃতের পুলিশি হেফাজতের আবেদন করা হচ্ছে।’’ তদন্ত প্রসঙ্গে এ দিন আদালতে ইডি-র আইনজীবীর বক্তব্য, ‘‘আলিবাবার বাক্সের মতো (অর্পিতার) আলমারি থেকে থরে থরে গয়না উদ্ধার হয়েছে। বৃহত্তর ষড়যন্ত্র খতিয়ে দেখা দরকার।’’
অর্পিতার ১৪ দিনের পুলিশি হেফাজতের আবেদন করে ইডি। কিন্তু অর্পিতার আইনজীবী নীলাদ্রি ভট্টাচার্য আদালতে বলেন, ‘‘অর্পিতা প্রথম থেকেই তদন্তে সহযোগিতা করছেন। তিনি কোনও ভাবেই প্রভাবশালী নন। সাক্ষ্য-প্রমাণ নষ্ট করার চেষ্টা করবেন না এবং পালিয়েও যাবেন না। তাঁর জামিন মঞ্জুর করা হোক।’’
বিচারক দু’পক্ষের আইনজীবীর বক্তব্য শোনার পরে এক দিনের জন্য তাঁকে ইডি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। ছুটির জন্য বন্ধ ছিল ব্যাঙ্কশাল আদালতের বিচারভবনে সিবিআই ও ইডি-র বিশেষ আদালত। শনিবার পার্থের মতো রবিবার অর্পিতাকে তাই সিএমএম এজলাসে তোলা হয়। ঠিক যেমন পার্থকে দু’দিনের জন্য ইডি হেফাজতে পাঠিয়ে বিচারক জানিয়েছিলেন, সোমবার তাঁকে ইডি-র বিশেষ আদালতে তুলতে হবে, তেমনই রবিবার অর্পিতাকেও এক দিনের জন্য ইডি-র হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। শেষমেশ আজ, সোমবার পার্থকে অবশ্য শারীরিক পরীক্ষার জন্য ভুবনেশ্বর-এমসে নিয়ে যাওয়ার কথা।
এ দিন অর্পিতাকে আদালত থেকে সোজা সল্টলেকে ইডি-র সদর দফতর সিজিও কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। শনিবার রাতেও তাঁকে সেখানে রাখা হয়েছিল। ইডি সূত্রের খবর, তাঁর শরীর খারাপ বলে মাঝেমধ্যেই জানিয়েছেন অর্পিতা। এ দিন সকালে সল্টলেক থেকে প্রথমে তাঁকে জোকার ইএসএআই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে এসে তোলা হয় ব্যাঙ্কশাল আদালতে।