সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়।
কলকাতার পুরভোট শেষ হওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই রাজ্য সরকারকে বেজায় অস্বস্তিতে ফেলে দিলেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার। কবুল করলেন, ‘‘আদর্শ পরিবেশে নির্বাচন হয়নি।’’ এতে অস্বস্তিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। যে কারণে শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তড়িঘড়ি তোপ দাগতে শুরু করেছেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়কে। তাঁদের বক্তব্য, ভোট পরিচালনার দায়িত্ব কমিশনের। সুতরাং, ভোট যদি অবাধ না হয়ে থাকে— তা দেখার কথা কমিশনেরই। তাঁদের প্রশ্ন, ‘‘যত ক্ষণ ভোট হয়েছিল, তত ক্ষণ কমিশন কোথায় ছিল?’’
ভোট যে আদর্শ পরিবেশে হয়নি, খোদ সুশান্তবাবুই তা স্বীকার করে নেওয়ায় উৎসাহিত বিরোধী দলগুলি। তবে রাজ্য সরকার ও তৃণমূলের সমালোচনা করার পাশাপাশি তাঁরা বিঁধছেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের বর্তমান কর্ণধারকেও। বিরোধীরা গোড়া থেকে বলে এসেছেন, মীরা পাণ্ডের অবসরের পরে কমিশনকে নিজেদের তাঁবেদার করে রাখতেই এক জন ডব্লিউবিসিএস অফিসারকে তার মাথায় বসিয়েছে তৃণমূল সরকার। আর এখন যখন সুশান্তবাবু ১৫০ কোম্পানি চেয়ে মাত্র ৩ কোম্পানি আধাসেনা পাওয়ার কথা বলে রাজ্য সরকারের ঘাড়ে দায় ঠেলার চেষ্টা করছেন, তখন তাঁকে তাঁর পূর্বসূরির কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন বিরোধীরা। তাঁদের বক্তব্য, ভোট সুষ্ঠু ও অবাধ করার জন্য মীরাদেবী আদালত পর্ষন্ত দৌড়েছেন, তাঁর জেদে পঞ্চায়েত ভোটও হয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর নজরদারিতে। সে ক্ষেত্রে সুশান্তবাবু তো রাজ্য সরকারের ইচ্ছেই পূরণ করেছেন। এখন, বাহিনী না পাওয়ার কথা বলে লাভ কী?
তৃণমূল ও তামাম বিরোধী দলগুলির আক্রমণের মুখে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার কার্যত এখন শাঁখের করাতে। তিনি বলছেন, ‘‘শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোট করার চেষ্টা করেছে কমিশন। তবে ভোট ‘আইডিয়াল’ পরিবেশে হয়নি।’’ এই বিবৃতি সরকারকে যতই অস্বস্তিতে ফেলুক না কেন, মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়ায় অস্বস্তির ধার ধারেননি। দিনের শেষে মমতা ঘোষণা করেছেন, ‘‘এমন শান্তির শহর দেখিনি। মানুষ উৎসবের মেজাজে ছিলেন।’’ যদিও সেই ‘উৎসবের’ বেলুনে পিন ফুটিয়েছেন খোদ নির্বাচন কমিশনারই। বলেছেন, ‘‘আদর্শ পরিবেশে ভোট হলে এত অভিযোগ আসত না।’’
রাজ্যের কোনও ভোটকে কেন্দ্র করে নির্বাচন কমিশনের এমন প্রতিক্রিয়া নজিরবিহীন। মুখ্যমন্ত্রী যা-ই বলুন, শনিবার সারাদিন শহর ঘুরে বিভিন্ন জায়গা থেকে যে সব খণ্ডচিত্র উঠে এসেছে, তা অনেকটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যের সঙ্গে। কমিশন সূত্রের খবর, এ দিনের নির্বাচনের বিষয়ে সুশান্তবাবু সোমবার রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীকে একটি রিপোর্ট দিতে পারেন। তার আগে আজ, রবিবার রাজনৈতিক দলগুলির আনা অভিযোগগুলি, মিউনিসিপ্যাল রির্টানিং অফিসার ও পর্যবেক্ষকদের রিপোর্ট এবং কমিশনের নিজস্ব ধারণা মিলিয়ে পুনর্নির্বাচনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সুশান্তবাবু। রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের মন্তব্যে উৎসাহিত হয়ে বিকেলের দিকে জোর তরজায় নেমে পড়লেও কলকাতার ১৪৪টি ওয়ার্ডে আট ঘণ্টার ভোট-আসরে কার্যত কোনও দাগ কাটতে পারেনি বিরোধী দলগুলি। কমিশনের কাছে বিজেপি ১৪৪টি ওয়ার্ড
এবং সিপিএম ২৫টি ওয়ার্ডে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। সেই দাবি মেনে কমিশন শেষ পর্যন্ত ক’টা ওয়ার্ড বা বুথে পুনর্নির্বাচনের ঘোষণা করে, তার দিকে তাকিয়ে আছে বিরোধীরা।
তৃণমূল শিবির অবশ্য ভোট ঘিরে সন্ত্রাস এবং অশান্তির যাবতীয় অভিযোগই উড়িয়ে দিয়েছে এ দিন। সুশান্তবাবুর বক্তব্য নিয়ে দলের শীর্ষ মহলের কটাক্ষ, সব পর্যবেক্ষকের রিপোর্ট কি হাতে এসে গিয়েছে যে, কমিশনার এখনই এই ধরনের মন্তব্য করছেন!’’ সরাসরি নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য নিয়ে কোনও মন্তব্য না করলেও মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘দু’চারটে বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। সেটা দুর্ভাগ্যজনক। যদিও ভোটের সময় কিছু কিছু ঘটনা
ঘটে থাকে। কিন্তু এ বার অনেক ঘটনার পিছনে বিরোধীদের নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও প্ররোচনা যে ছিল— তা স্পষ্ট। এর অর্থ এটা নয় যে, সামগ্রিক ভাবে সন্ত্রাস বা অশান্তিতে ভোট হয়েছে। তার পরেও যারা
এ সব বলছে, তারা সত্যের অপলাপ করছে।’’
বড় ধরনের কোনও গণ্ডগোল না হলেও এ দিনের ভোটে দুপুর ৩টে পর্যন্ত বিরোধীদের থেকে প্রায় ৭০টি অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার। অভিযোগের মধ্যে রয়েছে— ছাপ্পাভোট, সচিত্র পরিচয়পত্র ছাড়াই ভোট দেওয়া, পরিচয়পত্র কেড়ে নেওয়া, ভোটারকে ভয় দেখানো, বুথ জ্যাম করা, এজেন্ট তুলে দেওয়া, মারধর করা, বুথের কাছে জমায়েত করার মতো ঘটনা। কয়েকটি বুথের ওয়েবক্যামেরা ঘুরিয়ে দেওয়া, একটি বুথে ওয়েবক্যাম ভেঙে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। অনেক বুথে আবার ‘বাইরের লোক’ ঢুকেছে বলে অভিযোগ করেছেন কমিশন নিয়োজিত পর্যবেক্ষকরা। সুশান্তবাবুর কথায়, ‘‘পর্যবেক্ষক অপলা শেঠ তাঁর রিপোর্টে বুথের কাছে জমায়েতের ঘটনার কথা জানিয়েছেন। তাঁর চেষ্টায় অবশ্য পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে বলেও উল্লেখ রয়েছে রিপোর্টে।’’ পরে সুশান্তবাবু জানান, পর্যবেক্ষকরা ছাপ্পা ভোটের সব অভিযোগ খতিয়ে দেখে কোনও অনিয়ম পাননি। তবে
কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগের সারবত্তা রয়েছে বলেও কয়েক জন পর্যবেক্ষক রিপোর্ট দিয়েছেন।
বিরোধী দলগুলির আনা অভিযোগ ও পর্যবেক্ষকদের রিপোর্ট নিয়ে তিনি নিজে কী বলছেন?
সুশান্তবাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘ঠিক ভাবে ভোট হলে অভিযোগ কম আসত। কিছু লোক ভোট দিতে পারেননি বলেও অভিযোগ পেয়েছি। এটা অবশ্যই গণতন্ত্রের পক্ষে খারাপ নজির।’’ তাঁর কাছে আসা সব অভিযোগ পুলিশ, পর্যবেক্ষক এবং সংশ্লিষ্ট জেলাশাসকের কাছে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন বলে জানান কমিশনার।
শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও অবাধ ভোট করানোর ব্যাপারে কমিশনের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সিপিএমের রবীন দেব। বাকি পুরসভাগুলির ভোটে কি তাঁরা কমিশনের উপর ভরসা রাখছেন? জবাবে রবীনবাবু বলেন, ‘‘আমরা চাই, প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডের মতো সুশান্তবাবুও কার্যকর ব্যবস্থা নিন। পুলিশ যাতে সুষ্ঠু ও অবাধ ভোট পরিচালনা করতে পারে, কমিশন তার দায়িত্ব নিক।’’
বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের প্রতিক্রিয়া, ‘‘নির্বাচন কমিশন বাংলার গণতন্ত্রকে ধর্ষণে প্ররোচনা দিয়েছে। একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, ডব্লিউবিসিএস অফিসার দিয়ে নির্বাচন কমিশনারের কাজ হয় না।’’ কমিশনারের পদত্যাগ চেয়ে রাহুলবাবু দাবি করেন, ‘‘এই নির্বাচন বাতিল করে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে নতুন করে ভোট হোক।’’ ২৫ তারিখ বাকি পুরসভাগুলির ভোট অবাধ করতে চাইলে কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে কমিশনের চিঠি লেখা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি। রাহুলবাবু বলেন, ‘‘কলকাতার ভোট হল হাঁড়ির একটা ভাত। এটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বাকি ভাত কেমন হবে।’’
বিভিন্ন বুথে কংগ্রেসের উপর তৃণমূলের হামলার অভিযোগ জানিয়ে কমিশনারকে চিঠি দিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। কিন্তু কমিশনের কাছ থেকে এ দিন কোনও সাহায্য মেলেনি বলে অধীরের অভিযোগ। তাঁর আশঙ্কা, ‘‘২৫ তারিখেও ভোট শান্তিপূর্ণ হবে না।’’ এ দিন ১৯টি ওয়ার্ডে কংগ্রেসের প্রার্থী, কর্মীদের উপর হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ করলেও কেন তাঁরা পুনর্নির্বাচনের দাবি জানালেন না? তাঁর কটাক্ষ, ‘‘পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়ে কী হবে!’’