বিজেপি-র ব্রিগেড সমাগম। ছবি পিটিআই।
এ দেশে ভোট বড় বালাই। না হলে অতিমারির কালে ভোট হয়? ফোন করলেই যেখানে কয়েক সেকেন্ড ধরে ঘোষিকা বলে যাচ্ছেন, ‘সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স’ মানতে, সেখানে গণতন্ত্রের সব থেকে বড় উৎসব পালিত হয়? ভোট উৎসবে কোটি কোটি মানুষ আর নেতাদের ভিড়ে করোনা তো অনাহূত। তাকে চোখ রাঙিয়ে বলা হয়, ‘করোনা চুপ! গণতন্ত্র চলছে’।
ফলে যাবতীয় মিটিং, মিছিল, জনসভার ভিড়ে করোনার অস্তিত্বই থাকে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাস্ক আর স্যানিটাইজ়ার। অথচ মাসের পর মাস ধরে করোনার জুজু দেখিয়ে বন্ধ রাখা হয় সিনেমা হল। স্কুল-কলেজের ব্ল্যাকবোর্ডে চকের গুঁড়োর বদলে জমছে ধুলো। বাড়ি বসেই ‘অনলাইন ক্লাস’-এ অভ্যস্ত হয়ে ওঠে দেশের ভবিষ্যৎ। স্বাভাবিক মেলামেশাতেও বাধা করোনা। কিন্তু এমন আতঙ্ক গো-হারা হেরে যায় ভোট-মেলার কাছে।
কাঠফাটা রোদে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে স্বপ্ন দেখি, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আসবে আমার নির্বাচিত সরকার। কিন্তু ভুলে যাই, ক্ষমতায় এলে সরকার আর জনগণের থাকে না। বহু দিন ধরে এই ট্র্যাডিশন চলছে। মানিয়েও নিয়েছি এর সঙ্গে। বোতামে আঙুলের চাপ― এটুকুই আমার অধিকার, এ ভাবেই ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।
আমাদের প্রজন্মের কাছে যে অভিজ্ঞতা নতুন, তা হল একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে ধর্মের তাসে ভর করে একটি রাজনৈতিক দলের উত্থান এবং তাকে ক্ষমতায় আনা-না আনার চুলচেরা বিশ্লেষণে প্রতি রাতে আলাদা ক্ষেত্রে শিবির বদলে যায়। ধর্মের অধার্মিক চেহারা দেখেছিলাম বাবরি ধ্বংসের সময়ে। তখন আমি চার। পরে বুঝেছিলাম ধর্ম কত ভয়ঙ্কর হতে পারে। সে বার গলির কাছে কাজলের মায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল পুলিশ। বাবাকে জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন, ‘বড় হলে বুঝবে’। সেই বুঝতে পারা সুদে-আসলে মালুম হচ্ছে। ধর্ম ও রাজনীতির গাঁটছড়া ভয় পেতে শিখিয়েছে।
অথচ শৈশবে ধর্ম বলতে বুঝতাম, ঠাকুরমার শাঁখের আওয়াজ আর সন্ধ্যাপ্রদীপ, দুর্গাপুজোয় নতুন কাপড় পরে ঘোরা। ধর্ম মানে তো বাবার অফিস ছুটি, ঘুরতে যাওয়া, সরস্বতী পুজোয় প্রথম কুল খাওয়া। শীতে বন্ধ ফ্যানের দুপুরে ভেসে আসা ভাঙা কীর্তন আর আজানের আওয়াজ। সেই নিরীহ ধর্ম যে মানুষকে মারতে পারে, গোধরা না হলে বুঝতাম না। ধর্মীয় দাঙ্গা কত ভয়াবহ হতে পারে সেটা গুজরাট না হলে অজানা থেকে যেত। কাশ্মীর, শিখ নিধন, মুম্বই বিস্ফোরণ সবেতেই ধর্মের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে।
আমরা এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে, যেখানে রাজ্য ও কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন এবং বড়-ছোট-মাঝারি সব বিরোধী দল ভোটের অঙ্ক কষতে ধর্মের প্রতি কতটা নিবেদিত, সেটাই বোঝাতে মরিয়া। এটা ভয়ঙ্কর। কারণ, তখন দল তার কাজের প্রতি, দেশের নাগরিকের প্রতি কতটা অনুগত, ইস্তাহারের প্রতিশ্রুতি কতটা পূরণ করতে সক্ষম সেই সব প্রাসঙ্গিক থাকছে না। দেশের জনবসতির সত্তর শতাংশের বেশি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ যখন বিশ্বাস করেন যে তাঁরা নির্দিষ্ট অন্য একটি সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়ের দ্বারা অত্যাচারিত, তখন বোঝা যায় অন্ধ বিশ্বাসের পুরিয়া গিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে বোঝানো হতে থাকে তুমি কী খাবে, কী পরবে, ধর্মাচরণ কোন পথে হবে। আফিমের এই নেশায় ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় চাকরির দাবি, ফিকে হয়ে যায় মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে চিৎকার।
শুধু কি ফিকে হচ্ছে দাবিদাওয়া আর টাকার রং? বিজ্ঞান চেতনাকেও ফিকে করার পথে বিজ্ঞপ্তি এসেছিল ইউজিসি থেকে। বলা হয়েছিল গো-বিজ্ঞান পড়ানোর কথা! এর পরে হয়তো পাঠ্যসূচিতে ঢুকবে কল্পবিজ্ঞান, অতিবিজ্ঞান। পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো ছুটবে গো-বিজ্ঞানী হতে!
এক সময়ে আফগানিস্তানে হাঁটুর উপরে স্কার্ট পরে সাবলীল ভাবে ঘুরতেন মহিলারা। সেখানে এখন সবাই বোরখার আড়ালে। কেন? কী ভাবে শরিয়তি আইন থাবা গেড়ে বসেছিল ইরানের শিয়া সম্প্রদায়ের উন্নত ওই সাংস্কৃতিক পরিবেশে? বোঝার জন্য ইতিহাসের পাতা ঘাঁটতে হবে। তবে চোখের সামনেই দেখছি ভারত যাচ্ছে সেই পথেই। যে পথ নিয়ে যাচ্ছে হিন্দু রাষ্ট্র করার দিকে। সংস্কৃতায়নের ছায়া ফেলছে বিবিধের মাঝে মিলন মহানের এই দেশে।
সেই দিন হয়তো দূরে নয়, যখন ছোট্ট প্রতিবেশী দেশ ভুটানের কোনও আড্ডায় সে দেশের নবীন প্রজন্ম হাসাহাসি করবে আর বলবে ভারত হল সেই দেশ যেখানে কিছুই প্রাসঙ্গিক নয়, ধর্ম বাঁচানোর লড়াই ছাড়া।
মহাভারতে পড়েছি ধর্মযুদ্ধের কথা। সেই ধর্মযুদ্ধের অর্থ, পরিপ্রেক্ষিত অবশ্যই অন্য। কিন্তু সেই যুদ্ধও লড়িয়ে দিয়েছিল ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাইকে, বন্ধুর বিরুদ্ধে বন্ধুকে। বাস্তবের ধর্মযুদ্ধ হতে চলেছে আরও ভয়াবহ। যেখানে ভারত হবে কুরুক্ষেত্র।
(মতামত ব্যক্তিগত)